সাফা বেগ ও ইরফান পঠান। ছবি: ইরফান পঠানের টুইটার পেজ থেকে।
কট্টরবাদ নতুন নয়। আগেও ছিল। কিন্তু কট্টরবাদীদের সে কোলাহল কখনও ভারতের উদার-উদাত্ত কণ্ঠস্বরটাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আজ যেন ছাপিয়েই যাচ্ছে। উন্মুক্ত মনগুলো বার বার ধাক্কা খাচ্ছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক— সব পরিসরে ছবিটা একই রকম। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও ক্রিকেটারের সস্ত্রীক ছবি পোস্ট হতে দেখলেও যে চোখে ‘ধর্মের’ চশমাটা পরে নিতে হয় এবং তাতে যে ছবিটা অত্যন্ত আপত্তিকর দেখায়, এমনটা আগে জানা ছিল না। ইরফান পঠান নিজে তো জানতেনই না। সিংহ ভাগ ভারতবাসীও জানতেন না বলেই মনে হয়।
মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ইরফান পঠান কেন নারীর সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে নিলেন? কেন স্ত্রীয়ের হিজাব-হীন মুখের ছবি প্রকাশ্যে আনলেন? প্রশ্নগুলো এ ভাবেই ধেয়ে এসেছে ক্রিকেটারের দিকে। ‘ধর্মপ্রাণ’ প্রশ্নকর্তারা শুধু জিজ্ঞাসুই নন, তাঁরা বিস্ময়ে যেন হতবাকও! শুধু বিস্ময় প্রকাশেও সীমাবদ্ধ থাকেনি প্রতিক্রিয়া। তুমুল সমালোচনা হয়েছে, চূড়ান্ত অসৌজন্যমূলক আক্রমণ হয়েছে, অশালীন ইঙ্গিতে ইরফান পঠানকে কটাক্ষ করা হয়েছে।
এটা সোশ্যাল মিডিয়ার চেহারা! এটা একবিংশ শতাব্দীর মানসিকতা! এটা ভারতীয় মনন! ঠিক কতটা বিস্মিত হওয়া উচিত, বুঝে ওঠা যায় না আজ।
হিন্দুর কট্টরবাদ হোক বা মুসলিমের, সর্বত্রই যেন একটা জোয়ার এসে গিয়েছে। কিছুতেই যেন বেঁধে রাখা যাবে না আর এই স্বঘোষিত ধর্মপ্রাণদের। এরা মুক্ত চিন্তায় বা মত প্রকাশে বাধা দেয়, এরা সিনেমার প্রদর্শন আটকে দেয়, এরা শিল্পীর হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিতে চায়, এরা সাহিত্যিকের কলমে লাগাম লাগাতে চায়, এরা সহ-নাগরিকের রসনা বা খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, এরা বহুত্বের মাহাত্ম্য বোঝে না, এরা সংস্কৃতিকে একমাত্রিক-একরঙা-একঘেয়ে ফ্রেমের মাঝে দেখতে চায়।
মানবসভ্যতাকে নিরন্তর পিছনের দিকে টেনে ধরতে চাওয়া এই শ্রেণির অস্তিত্ব আগে ভারতে অনেক দুর্বল ছিল। দেশ জুড়ে, সামাজিক পরিসর জুড়ে, রাজনীতির উঠোন জুড়ে এদের এত দাপট ছিল না। একটা ভারসাম্য ছিল। ভারসাম্যটা ছিল বলেই ভারতের অগ্রগতিটা কখনও ব্যহত হয়নি।
কিন্তু এ বার কী হবে? যে ভাবে নিজের দাপট বাড়াচ্ছে কট্টরবাদ, যে ভাবে ভারসাম্যটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যে ভাবে রোজ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে আশপাশটা, তাতে আত্মঘাতী সঙ্ঘাত কিন্তু অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। কিন্তু এই কট্টরবাদের ঠিক উল্টো মেরুতে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাও তো সংখ্যায় কম নন। তাঁরাও তো লক্ষ-কোটি। তাঁরা কি আজ হাত গুটিয়েই থাকবেন? আত্মসমর্পণ করবেন? বহু কষ্টার্জিত অধিকারগুলো বেহাত হয়ে যেতে দেবেন? তাই যদি করেন, ইতিহাস কিন্তু আপনাদের দিকেও আঙুল তুলবে।