পাটনায় মমতা।
নীল পাড় অফ হোয়াইট শাড়ি। টেনে চুল বাঁধা। সবুজ লনে সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে তিনি। হাতের মোবাইলে অনবরত টুকটুক করে চলেছেন। হয়তো এসএমএস করছেন। হঠাত্ই স্বগতোক্তির ঢঙে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘এ বার আমি ঝাঁপাব। এনাফ ইজ এনাফ। টাইম ইজ আপ।’
নভেম্বরের দিল্লিতে হাল্কা শীত পড়েছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৮৩, সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়ির লনে বসে থাকা মমতা গরম দুধ-চায়ে আলতো চুমুক দিলেন। তার পর জানালেন, এ বার তাঁর ভারত যাত্রার শুরু। মোদী-বিরোধী সব রাজনৈতিক দল ‘এক হো’— এই স্লোগান দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। তাঁর কথায়: ‘‘অতীতে যখন আন্দোলন শুরু করেছি তখনও আমি একা ছিলাম। চিরকালই তা-ই। কিন্তু পরে সকলে এসেছেন। সে দিনও নিজের জন্য কিছু করিনি, মানুষের স্বার্থে করেছি, আজও গোটা দেশের মানুষের অসুবিধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’’
ভারতীয় রাজনীতিতে ‘বিরোধী ঐক্য’ বস্তুটি নিতান্ত কাঁঠালের আমসত্ত্ব নয়। এটা বার বার টের পাওয়া গিয়েছে। জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গাঁধীর বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে একদা বিরোধী শিবির ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে বোফর্স দুর্নীতিকে অস্ত্র করে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহকেও দেখেছি। এক দিকে কমিউনিস্ট, অন্য দিকে বিজেপি। দু’পক্ষকেই সঙ্গে নিয়ে সরকার গড়েছিলেন তিনি। সেই সময় প্রত্যেক সোমবার বিশ্বনাথপ্রতাপ বাম ও বিজেপি দু’পক্ষকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিবাসে নৈশভোজে মিলিত হতেন। উদ্দেশ্য ছিল সমন্বয়। সেখানে লালকৃষ্ণ আডবাণী এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ও হাজির থাকতেন। এক দিকে নিরামিষাশীদের জন্য ব্যুফে, অন্য দিকে আমিষাশীদের জন্য। সোমনাথ যেতেন নন-ভেজ লাইনে আর আডবাণী ভেজের। দু’জন দু’দিকে। কেউ কারও সঙ্গে কথাও বলতেন না। কিন্তু, বিশ্বনাথপ্রতাপ দুটো লাইনে গিয়েই ঘুরে ঘুরে সৌজন্য বিনিময় করতেন।
এখন মমতা এই সমন্বয়সাধনে সক্রিয়। কেজরীবাল তাঁকে পরামর্শ দেন, ‘‘চলুন, আমরা দু’জনে মিলে গোটা ভারত চষে বেড়াই।’’ কিন্তু, সম্প্রতি রাজধানীতে কয়েক দিন থেকে মমতা বুঝতে পেরেছেন কেজরীবাল সরকারের বিরুদ্ধেও দিল্লির মানুষের অসন্তোষ আগের তুলনায় বেড়ে গিয়েছে। তাঁর সেই জনপ্রিয়তাও আর নেই। আবার মমতা এটাও উপলব্ধি করেছেন যে, মোদী বিরোধী সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলকেও তাঁর প্রয়োজন। এ জন্য তিনি সনিয়া এবং রাহুল গাঁধী সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেই এগোতে চাইছেন।
কিন্তু, মমতা ডাক দিলেও নরেন্দ্র মোদীর ডিমনিটাইজেশনের বিষয়ে সকলে একই ছাতার তলায় এসে এখনও দাঁড়ায়নি। এ বিষয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। কেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে সদলবল যাওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করলেও কংগ্রেস তাতে শামিল হল না? কেন অরবিন্দ কেজরীবালও নিজে হাজির হতে চাইলেন না? মমতার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার পিছনে প্রধান কারণটা কী? রাজধানীর এই নেতাদের খুব কাছ থেকে দেখে বুঝতে পেরেছি, পারস্পরিক সব ভেদাভেদ ভুলে এখনই অন্য রাজনৈতিক নেতারা মমতার ছাতার তলায় আসতে রাজি নন।
কেন?
তার প্রধান কারণ, বিরোধী নেতারা মোদীকে সরাতে যতটা আগ্রহী তার চেয়েও বেশি আগ্রহী নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে দেখতে। এ বার তাই নিজেই ভারত দর্শনে বদল আনছেন মমতা। হয়তো সে দিক থেকে দেখলে অল্প সময়ের মধ্যে গত দু’টি দিল্লি সফরের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাগুলি তাঁর চলার পাথেয়। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা গ্রহণের প্রাক্কালে মমতা কলকাতা থেকে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে বেশ কয়েক বার কথা বলেন। কিন্তু, তিনি যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দুপুর দেড়টায় দেখা করার জন্য সময় চেয়ে তা নিশ্চিত করে ফেলেন এবং ওই কর্মসূচিতে কংগ্রেসকে যোগ দিতে বলেন, তখন রাহুল সে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান না করলেও উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। উল্টে গুলাম নবি আজাদ সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন, আগে সংসদে মোদী সরকারের বিরোধী হাঙ্গামা হোক। মোদীকে সংসদে এসে কথা বলতে বাধ্য করা হোক। সংসদে বিতর্ক হোক। তার পর ধাপে ধাপে আমরা সংসদ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। আহমেদ পটেল প্রস্তাব দেন, কংগ্রেস, তৃণমূল ও অন্য সকল বিরোধী দল একত্রিত হয়ে সংসদ অভিযান হোক প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু, তত ক্ষণে মমতা তাঁর রাষ্ট্রপতি ভবন যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করে দিয়েছেন। উল্টে এনডিএ-র শরিক শিবসেনা শামিল হয়েছে মমতার মঞ্চে। কাজেই তখন মমতার পক্ষে দিল্লি এসে সেই কর্মসূচি থেকে সরে আসা কঠিন ছিল। কিন্তু, এই রাজনৈতিক বোধোদয়ের ভিত্তিতে আরও পরিশীলিত কৌশলে তিনি ফের মোদী-বিরোধী প্রচার অভিযানে নামলেন। সংসদে ও সংসদের বাইরে।
সাম্প্রতিক এই দু’টি দিল্লি সফরে মমতার উপলব্ধি, বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে এখনই কোনও ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করা উচিত নয়। কে নেতা সেটা নিয়েও তত্ত্বতালাশ অগ্রাধিকার নয়। আক্রমণের এখন একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেটা হল নরেন্দ্র মোদী। এমনকী, সামগ্রিক ভাবে বিজেপি বা বিজেপি-র মন্ত্রীদের আক্রমণের লক্ষ্য না করে মোদীকে একক ভাবে নিশানা করাটা সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন মমতা। ডিমনিটাইজেশনের ব্যাপারটা প্রচারের একটি আপাত হাতিয়ার মাত্র। আসলে রাহুল গাঁধীই হোন আর মমতা, সব বিরোধী নেতারই লক্ষ্য মোদী-বিরোধী জনতার অসন্তোষকে মূলধন করে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী ঐক্যকে মজবুত করা। মোদী অবশ্য মনে করেন বিপরীত। তিনি ভাবছেন, তাঁর অন্য সব ব্যর্থতা ঢেকে এই কালো টাকা বিরোধী অভিযানে গরিব মানুষের সমর্থন পাবেন।
ঝুঁকি দু’পক্ষই নিচ্ছে। আসন্ন উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের ফলাফল এই রাজনীতির অভিমুখ নির্ধারণে নেবে এক মস্ত বড় ভূমিকা। তাই আপাতত বক্সিং রিং-এর বাইরে ওঁত পেতে বসে আছেন বেশ কিছু চরিত্র। যেমন লালু-নীতীশ, অখিলেশ-মায়াবতী, শরদ পওয়ার প্রমুখ। এই বিরোধী নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়েছেন মমতাই। গত পনেরো দিনে সর্বাধিক সরব বিরোধী কণ্ঠ হয়ে উঠেছেন মমতা। তিনি ঝাঁপ দিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ঝাঁপটা সফল হবে তো?