ওরগ্রামের অরণ্য। নিজস্ব চিত্র
‘একটা অদ্ভুত শব্দ। /নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল। / আগুন জ্বললো আবার— উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হ’য়ে এলো। / নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় ব’সে অনেক পুরানো শিশিরভেজা গল্প; / সিগারেটের ধোঁয়া;/ টেরিকাটা কয়েকটা মহিষের মাথা;/ এলোমেলো কয়েকটা বন্দুক— হিম– নিঃস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।’’ তাঁর ‘শিকার’ কবিতায় সে কালের শিকারিদের এমনই ছবিই এঁকেছিলেন জীবনানন্দ। শুধু তিনিই নয়, উনিশ ও বিশ শতকের সাহিত্যে আমরা পেয়েছি শিকারের অনুষঙ্গ। এক সময় রাজা বা জমিদারদের কাছে শিকার নিতান্ত ‘প্রমোদোৎসব’ নয়, গণ্য হত ‘শৌর্য ও বীরত্ব’-এর পরিচয় হিসেবে। দিনের পর দিন জঙ্গলে শিকার করে বেড়াতেন জমিদারেরা। বর্তমানে ‘বণ্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন’ প্রবর্তনের ফলে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। বাঘ, সিংহের মতো প্রাণীদের রক্ষায় পদক্ষেপ করার জন্য মুখর হচ্ছেন পরিবেশপ্রেমীরা। আজকের যুগে অরণ্য প্রেমিকেরা বন্দুক নয়, জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান ক্যামেরা হাতে নিয়ে। জঙ্গল ও প্রাণীদের সৌন্দর্য ধরা পড়ছে ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি’-তে।
রাজ আমলে জঙ্গলে প্রকাণ্ড বিলাসবহুল তাঁবু খাটিয়ে শিকারের রীতি প্রচলিত ছিল। রাজারা কখনও পার্ষদদের সঙ্গে কখনও বা সপরিবারে জঙ্গলে শিকারে যেতেন। জঙ্গল তোলপাড় করে পশুপাখি মেরে দিন কাটত। এই প্রমোদোৎসবের জন্য কোনও কোনও জঙ্গলে তৈরি করা হয়েছিল বিলাসবহুল বাংলো। সেই সব বাংলোর অস্তিত্ব আজও ভারতের নানা প্রান্তে রয়েছে। সরকার এমনই কিছু প্রাসাদোপম বাংলোকে ‘রিসর্ট’-এ পরিণত করেছে।
এখনও বেশ কিছু প্রবীণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে ‘হাঁকোয়া পার্টি’ সম্পর্কে জানা যায়। সাধারণত জমিদারেররা যখন শিকারে যেতেন, তখন গ্রামের সাধারণ মানুষকে নিয়ে এই দলটি তৈরি করতেন। শয়ে শয়ে মানুষ বাজি, গান, বাজনা প্রভৃতির মাধ্যমে জন্তু, জানোয়ারদের তাড়িয়ে নিয়ে আসতেন। হাতির পিঠে নিরাপদে বসে থাকা রাজারা গুলি চালিয়ে শিকার করতেন। শিকারের প্রথা ইংরেজ প্রভুদের একাংশের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশরাও কখনও দল বেঁধে, কখনও একা গভীর জঙ্গলে শিকার করতে যেতেন। তাঁদের থাকার জন্যও বেশ কিছু ‘ফরেস্ট বাংলো’ও তৈরি হয়েছিল। ‘জিম করবেট’, ‘কানহা’-র মতো নানা জাতীয় উদ্যানে আজও এই ধরনের ফরেস্ট বাংলো রয়েছে।
স্বাধীনোত্তর ভারতেও বেশ কিছু দিন ‘শিকার প্রথা’ প্রচলিত ছিল। বিদেশ থেকেও অনেকে ভারতের অরণ্যে শিকার করতে আসতেন।এই নির্বিচারে শিকারের ফল হল মারাত্মক। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ১৯০০ সালে যেখানে সারা দেশে এক লক্ষের কাছাকাছি বাঘ ছিল সেখানে ১৯৭০ সালে বাঘের সংখ্যা এসে দাঁড়াল মাত্র চার হাজারে। অবশেষে টনক নড়ল সরকারের। ১৯৭০ সালে প্রচলিত হল ‘বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন’।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিকার সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলেছে। আজ অধিকাংশ মানুষের কাছে শিকার কোনও বীরত্বের পরিচয় নয়। তবে বাজারে নানা পশুর দেহাংশ ও চামড়ার কদর কমেনি। তাই তৈরি হয়েছে চোরাশিকার দল, পাচারের চক্র। আজও বাঘ, গণ্ডার-সহ নানা প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে চোরাশিকারিদের হাতে। প্রাণীদের বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ করছে সরকার ও প্রশাসন। এক দিকে, যেমন একাধিক অরণ্যকে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। অন্য দিকে, তেমনই বনাঞ্চল বাড়াতেও নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে নানা অভয়ারণ্য। বণ্যপ্রাণীদের সঙ্গে মানুষের নৈকট্য বাড়তে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘ইকো ট্যুরিজম পার্ক’। পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণ রক্ষায় নতুন পথের দিশা দেখাচ্ছে ইকো ট্যুরিজম।
ইকো ট্যুরিজমের হাত ধরে এক দিকে যেমন, বন্যপ্রাণ ও প্রাণীদের সংরক্ষণ সম্ভব, অন্য দিকে, তেমনই পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের পথও তৈরি হচ্ছে। কয়েকটি সমীক্ষা বলছে, ইকো ট্যুরিজমের মাধ্যমে যদি স্থানীয় মানুষদের বিকল্প রুটিরুজির বন্দোবস্ত করা যায় তা হলে তাঁরা নিজে থেকেই এগিয়ে আসবেন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কাজে। এই কাজটিই করে দেখিয়েছে জিম করবেট, কানহা, বান্ধবগড়, তাড়োয়া, রনথম্বোরের মতো জঙ্গল। এখানে সাফারির জন্য স্থানীয়দের নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে। জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে এ রকম প্রায় ৪০০ সিন্ডিকেট রয়েছে। উল্টো দিকে, ওডিশা, ঝাড়খণ্ড বা উত্তর-পূর্বের জঙ্গগুলিতো ‘ইকো ট্যুরিজম’ সে ভাবে গড়ে না ওঠায় বন এবং বন্যপ্রাণী বিপন্ন হচ্ছে। এই সব অরণ্য গাছ কমছে। বন্যপ্রাণীর সংখ্যাও ক্রমশ কমছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্য।
ইকো ট্যুরিজমের প্রসারের সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের দু’ই বর্ধমানেও। পূর্বস্থলীর চুপি চরে আসে প্রচুর পরিযায়ী পাখি। কাঁকসার গড় জঙ্গলে রয়েছে প্রচুর দর্শনীয় স্থান এবং জীববৈচিত্র। সরকার একটু নজর দিলেই এই জেলায়ও ইকো ট্যুরিজমের মাধ্যমে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়া যায়। পূর্বস্থলীতে পর্যটনের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পাখি শিকার অনেকটাই কমেছে। কাঁকসার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পর্যটনের পরিকল্পনা করছে সরকার। তবে ইকো ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সচেতনতাও মেনে চলা প্রয়োজন। জঙ্গলে পর্যটকেরা যেন নিয়ম মেনে চলনে। পশুদের শান্তি যাতে কোনও ভাবেই নষ্ট না হয় সে দিকেও নজর দেওয়া জরুরি।
দুর্গাপুরের পরিবেশ ও সংস্কৃতিকর্মী