ছবি পিটিআই।
বার বার প্রশ্ন উঠে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিকে প্রত্যাখ্যান করিয়াই চলিতেছে? দেশের সকল মানুষের জন্য যে প্রকল্প রূপায়িত হইতেছে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেই প্রকল্প হইতে বঞ্চিত হইবে কেন? কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির সহিত রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক বিরোধের মূল্য রাজ্যবাসী চুকাইবে কেন? প্রশ্নগুলি সচরাচর বিজেপির নেতারা করিয়া থাকেন। বিধানসভা নির্বাচন যত নিকটবর্তী হইতেছে, প্রশ্নের তীব্রতাও বাড়িতেছে। সম্প্রতি এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আসিয়া ফর্দ ধরাইয়া গেলেন— আয়ুষ্মান ভারত হইতে প্রধানমন্ত্রী কৃষি সম্মান যোজনা, জল জীবন মিশন, হরেক কেন্দ্রীয় প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে হয় গৃহীত হয় নাই, অথবা সরকারি উদ্যোগের অভাবে যথাযথ ভাবে রূপায়িত হয় নাই। প্রশ্নগুলি উত্থাপনের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে রাজনৈতিক, তাহা স্বীকার করিয়াও বলিতে হয়, প্রশ্নগুলি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতির হাড়িকাঠে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে বলি দেওয়া চলে না। পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন আত্মপক্ষ সমর্থনে বলিতে পারে, কেন্দ্রীয় প্রকল্প গ্রহণ না করিলেও রাজ্যের মানুষকে বঞ্চিত করা হয় নাই। আয়ুষ্মান ভারত-এর বদলে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প হইয়াছে, কৃষকদের সহায়তার ব্যবস্থাও হইয়াছে। কিন্তু, উত্তরটি যথেষ্ট নহে। রাজ্যের আর্থিক সামর্থ্য স্বভাবতই সীমিত। কেন্দ্রীয় প্রকল্প গ্রহণ করিলে রাজ্যের কোষাগারের টাকা উন্নয়নের অন্য কাজে লাগানো যাইত।
কিন্তু বিষয়টি এতখানি সরলও নহে। লক্ষণীয়, যেগুলি ‘কেন্দ্রীয় প্রকল্প’ নামে পরিচিত, তাহার অনেকগুলির ক্ষেত্রেই (পরিভাষায়, সেন্ট্রালি স্পনসরড স্কিম) কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত রাজ্য সরকারেরও আর্থিক অবদান থাকে। সেই প্রকল্পগুলির প্রচ্ছদে যদি প্রধানমন্ত্রীর ছবি শোভা পায়, এবং রাজ্য সরকারের অবদানের কোনও প্রতিফলনমাত্র না ঘটে, তবে তাহা সঙ্গত কাজ হয় না, হইয়া দাঁড়ায় নিছক রাজনৈতিক প্রচার। নিজেদের কোষাগারের অর্থ ব্যয় করিয়া প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রচার করিতে পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য কোনও রাজ্যের আপত্তি থাকিতেই পারে। আবার, জিএসটি ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ প্রদানে কেন্দ্রীয় গড়িমসিও কর্তব্য সম্পাদনের প্রকৃষ্ট পন্থা নহে। বিশেষত এই বৎসর, যখন কোভিড ও লকডাউনের জোড়া ধাক্কায় রাজ্যগুলির নাভিশ্বাস উঠিতেছে। জিএসটি ব্যবস্থার ফলে রাজ্যগুলির নিজস্ব রাজস্ব আদায়ের পথ কার্যত বন্ধ। এই অবস্থায় কেন্দ্র টাকা বকেয়া রাখিলে, হরেক কুযুক্তির অবতারণা করিলে, তাহা রাজ্যগুলির পক্ষে মর্মান্তিক হওয়া স্বাভাবিক।
পশ্চিমবঙ্গের জন্য এই শেষ কথাটি বিশেষ ভাবে সত্য। কারণ, অতিমারি ও লকডাউনের উপর এই রাজ্যকে আমপান নামক প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের ধাক্কাও সামলাইতে হইয়াছে। রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঝড়ের দাপটে প্রায় মাটিতে মিশিয়া গিয়াছে— তাহাকে নূতন ভাবে গড়িয়া তুলিবার দায় বর্তায় রাজ্য প্রশাসনের উপর। অতিমারির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিতে, লকডাউনের আর্থিক ধাক্কা সামলাইতে যে রাজকোষ বিপর্যস্ত, এই ঝড়ের ঝাপটার শুশ্রূষা করিতে তাহার কেন্দ্রীয় সাহায্যের প্রয়োজন ছিল প্রশ্নাতীত। প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টার চড়িয়া রাজ্যের বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করিয়া মাত্র এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণা করিয়া দিল্লি ফিরিয়াছিলেন। তাহার পর প্রায় সাত মাস কাটিয়া গিয়াছে। আমপানের ক্ষতিপূরণ বাবদ জাতীয় ত্রাণ তহবিল হইতে ২৭০৭ কোটি টাকা আসিল, রাজ্য সরকারের হিসাবে যাহা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। এই বিমাতৃসুলভ আচরণের মধ্যে কেহ রাজনীতির ছায়া দেখিলে দোষ দেওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় প্রকল্প রূপায়ণে রাজ্যের অনীহা যেমন দুর্ভাগ্যজনক, পশ্চিমবঙ্গের বকেয়া অর্থসাহায্য আটকাইয়া রাখাও সমধিক অন্যায়।