প্রতীকী ছবি।
২০১২ সাল হইতে ২০১৯। সাত বৎসরে যেন এক বৃত্তাকার যাত্রা হইল, এবং যেখান হইতে শুরু করা গিয়াছিল, সেইখানে আবার ফিরিতে হইল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মর্মান্তিক রাত্রির পর প্রথমে দিল্লি এবং পরবর্তী কালে সমগ্র ভারত যাহা দেখিয়াছিল, ২০১৯-এর হায়দরাবাদে শেষ নভেম্বরের রাত্রির পর ঠিক সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটিল। এক তরুণীকে গণধর্ষণ করিয়া নৃশংস হত্যা, প্রতিবাদ মিছিল, ধর্ষিতার করণীয় বিষয়ে মন্ত্রীর অসংবেদনশীল মন্তব্য এবং ধর্ষকদের ‘ফাঁসি চাই’-এর তুমুল দাবি। অথচ, সাত বৎসরের ঘটনাক্রম কিছু আশা জাগাইয়াছিল। আশা হইয়াছিল, দেশের প্রতিটি মেয়ের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হইবে, নিরাপত্তাদানে প্রশাসনিক তৎপরতা এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে একত্র প্রতিবাদ আসিবে। সাত বৎসরে সেই আশায় একের পর এক আঘাত আসিতেছিল। পরিসংখ্যান বলিতেছিল, নির্ভয়া কাণ্ডের পর দেশে সরকার পরিবর্তিত হইয়াছে, কিন্তু ধর্ষণের সংখ্যা বিন্দুমাত্র কমে নাই। তথাপি ন্যায়বিচারের আশা মরিতে মরিতেও জ্বলিতেছিল। সম্প্রতি ধর্ষকদের পেট্রলের আগুনে হায়দরাবাদে চিকিৎসক মেয়েটির দেহের সঙ্গে সেই আশাও পুড়িয়া ছাই হইল। আইনকানুন বিচার প্রতিবাদ সব মিথ্যা প্রমাণিত। এই দুর্ভাগা দেশে একটি মেয়েও নিরাপদ নহে।
লক্ষণীয়, ২০১৪ সালে শাসক দলকে সরাইয়া যাঁহারা কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসিলেন, তাঁহারা নির্বাচনী ইস্তাহারে ফলাও করিয়া মেয়েদের উপর ঘটিয়া চলা অপরাধের অবসানের আশ্বাস প্রদান করিয়াছিলেন। যেন পূর্ববর্তী শাসনে মেয়েরা যত অনাচার, অত্যাচারের শিকার হইয়াছিলেন, সমস্ত কিছুর অবসান হইবে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর সেই আশ্বাসে যে মেয়েদের নিরাপত্তার মতো এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের রাজনীতিকরণ ভিন্ন সারবত্তা কিছু নাই, তাহা নিতান্তই নির্বাচনী চমক, সেই কথাটি এত দিনে প্রমাণিত হইয়াছে। অথচ, ২০১২ সালের পর হইতে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ মুছিবার উদ্দেশ্যে সরকার এবং মহিলা— উভয়ের হাতেই বেশ কিছু অস্ত্র আসিয়াছে। ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন কঠোরতর হইয়াছে, নির্ভয়া তহবিল গঠিত হইয়াছে, মহিলাদের জন্য হেল্পলাইন নম্বর চালু হইয়াছে, সর্বোপরি, ধর্ষণ লইয়া সামাজিক সচেতনতাও বহু গুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। অথচ, সমাজের নিরাপত্তার অভাব কেবল একই জায়গায় থাকে নাই, পুলিশ-প্রশাসনও একই রকম ভাবে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন বলিয়া নিজেকে প্রমাণ করিয়াছে। নতুবা, কন্যার নিখোঁজ হইবার ডায়েরিটুকু করিতে ধর্ষিতার পিতাকে একের পর এক থানায় ঘুরিতে হইত না।
ইহার ব্যাখ্যা ঠিক কী? আইন থাকিলেও সেই আইন মান্য হয় না কেন? একের পর এক ঘটনা ঘটিয়া চলিলেও মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায় না কেন?সম্ভবত এই সকল প্রশ্নের উত্তর লুকাইয়া আছে এক বিষাক্ত পৌরুষের সাধনার মধ্যে, এবং তাহাকে বাহির ও ভিতর হইতে ক্রমাগত প্রশ্রয় দানের মধ্যে। সেই পৌরুষের বক্তব্য: নারী শুধু পুরুষের সম্পত্তি নহে, নারীকে সম্পূর্ণরূপে দমন ও দমনপূর্বক ভোগ না করিতে পারিলে জগৎ মিথ্যা। স্বভাবতই ধর্ষণ সংস্কৃতির সহিত এই সামগ্রিক ভাবধারাটির সংযোগ অত্যন্ত গভীর। যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবেচনামতে, আদর্শ নারী আপন গৃহের বাহিরে পদার্পণ করে না, ইচ্ছামতো পোশাক পরিধান করে না, যত্রতত্র বিচরণের অবাধ্যতা দেখায় না— একবিংশ শতকের ভারতীয় নারীকে তাহা সুরক্ষা দিবে কী ভাবে? আসল কথাটি তাই আইন বিচার প্রতিবাদ মিছিলের বাহিরে, অনেক বৃহৎ পরিসরে, অনেক গভীর সঙ্কটের রূপে স্তরে স্তরে জমিয়া আছে। সেই স্তরীভূত অন্ধকারে ধাক্কা না মারিলে কঠোরতম আইনও বিফলে যাইতে বাধ্য।