—ফাইল চিত্র।
অসৎ হইতে সৎ-এ, তমসা হইতে জ্যোতিতে, মৃত্যু হইতে অমৃতে গমন করিতে কাহারও আপত্তি থাকিবার কথা নহে। তবে দেশের সহস্রাধিক কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের প্রাত্যহিক প্রার্থনায় এই কথাগুলি উচ্চারণের বিষয়ে আপত্তি উঠিল কেন? কেবল আপত্তি উঠে নাই, উপনিষদ হইতে আহৃত দুইটি প্রার্থনাসঙ্গীত কেন সরকারি বিদ্যালয়ে আবশ্যিক হইবে, এই মর্মে সুপ্রিম কোর্টে দুইটি আবেদন পেশ হইয়াছে এবং সর্বোচ্চ আদালত তাহার মীমাংসার দায়িত্ব সংবিধান বেঞ্চের হাতে তুলিয়া দিয়াছে। অভিযোগকারীদের যুক্তি: উপনিষদের শ্লোকগুলি চরিত্রে ধর্মীয়। হিন্দুধর্মের মন্ত্রস্বরূপ। সুতরাং তাহা পাঠ করিবার বাধ্যতা অন্য ধর্মাবলম্বীদের (বা সাধারণ ভাবে অ-বিশ্বাসীদের) ধর্মাচরণের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল হয়, তাহাতে এই বিষয়ে সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। বিজেপি-প্রধান কেন্দ্রীয় সরকার এই মতের প্রত্যাশিত বিরোধিতা করিয়াছে। কিন্তু বিচারপতিরা প্রশ্নটিকে নাকচ করেন নাই, বরং সংবিধান বেঞ্চে পাঠাইয়া স্বীকার করিয়াছেন যে, ইহা একটি গুরুতর প্রশ্ন।
প্রশ্নটি বাস্তবিকই গুরুতর। আদালত শেষ অবধি কী সাব্যস্ত করিবে, কী ধরনের যুক্তি ও প্রতিযুক্তি বিচার করিয়া সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাইবে, তাহা ভারতীয় সংবিধান তথা গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের উপাদান সংগ্রহ করিবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। বস্তুত, এই ধরনের বিশ্লেষণের মাধ্যমেই রাষ্ট্র ও সমাজের চিন্তা প্রসারিত হয়, বোধ গভীরতর হয়। এ দেশে ফলিত রাজনীতির ক্লেদ সেই চিন্তাকে অতিমাত্রায় আবিল করিয়াছে, প্রতিনিয়ত সেই আবিলতা বাড়িতেছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় সংক্রান্ত বিষয়টি লইয়াও জল ঘোলা হইবার আশঙ্কা প্রবল। এই ভয় অহেতুক নহে যে, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের কারবারিরা দেখিতে দেখিতে ভোটের মন্ত্রে জাগিয়া উঠিয়া বলিবেন: ভারতে বাস করিয়া পবিত্র উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণে আপত্তি করে কোন পাষণ্ড? মেরুকরণের রাজনীতি প্রয়াগের জলে আরও কয়েক বার ডুব দিয়া বাড়তি শক্তি সংগ্রহ করিয়া লইবে। সেই কারণেই এই বিষয়ে সুস্থ আলোচনার প্রয়োজন সমধিক। আদালতের বিচার অবশ্যই তাহার সহায়ক হইবে।
যে কথাগুলি লইয়া বিতর্ক, প্রকৃত অর্থে তাহারা বিশেষ ধর্মমতের কথা নহে, জীবনদর্শনের গভীর বাণী। মননশীল মানুষ যুগে যুগান্তরে তাহাদের সেই ভাবেই দেখিয়াছেন। দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথ। সেই হিসাবে কেহ বলিতেই পারেন যে, স্কুলের দৈনিক শিক্ষারম্ভে এই কথাগুলি বলিতে ধর্মমত নির্বিশেষে কাহারও আপত্তি হইবে কেন। কিন্তু সমস্যা হইল, দীর্ঘ ব্যবহারিক পরম্পরায় এই সকল শ্লোক বা সূক্ত, তাহাদের উৎস উপনিষদের মতো বিবিধ গ্রন্থ, এমনকি সংস্কৃত ভাষার অঙ্গে ধর্মাচরণের ও ধর্মবিশ্বাসের ছাপ তথা কলঙ্কচিহ্ন লাগিয়াছে। এ যুগে, বিশেষত সাম্প্রতিক কালে, তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে ধর্মাশ্রিত রাজনীতি। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দাপট যত বাড়িয়াছে, কলঙ্কচিহ্ন তত গভীর হইয়াছে। এই কারণেই আজ আর ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’-র মতো উত্তরণের মন্ত্রকেও ধর্মমতনিরপেক্ষ বাণী হিসাবে দেখানো সহজ নহে, হয়তো সম্ভবপর নহে। বিশেষত সেই বাণী উচ্চারণে কাহাকেও, বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নিজস্ব স্কুলের শিক্ষার্থীদের, বাধ্য করিবার নৈতিকতা লইয়া প্রশ্ন উঠিবেই। যেমন উঠিয়াছে।