আপৎকালে: (বাঁ দিক থেকে) দেবেন্দ্র ফডণবীস, উদ্ধব ঠাকরে, অমিত শাহ এবং উদ্ধব-পুত্র আদিত্য ঠাকরে। মুম্বই, ৬ জুন। পিটিআই
রাম-রাজনীতিতে ব্যস্তসমস্ত নেতারা কি কখনও ভেবেছিলেন যে স্বয়ং রামই তাঁদের বিপক্ষে যেতে পারেন? রামকে এমন ব্যুমেরাং ভাবা মুশকিল। তাই উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিক ওমপ্রকাশ রাজভড় যখন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে প্রচারমাধ্যমের সামনে বিজেপিকে রাম-গালি দিলেন, কে জানে দিল্লি থেকে লখনউ অবধি কী ধরনের বার্তা চালাচালি হয়েছিল!
সেটা ছিল মার্চ। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মন্ত্রিসভার সদস্য, শরিক নেতা ওমপ্রকাশ, গোরক্ষপুর-ফুলপুরে উপনির্বাচনে বিজেপির অপ্রত্যাশিত হারের কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করলেন: যেমন কর্ম তেমনি ফল, বিজেপির ভাবটা এমন যে বাকি সবাই বানরসেনা, ওঁদের পিছন পিছন যাওয়াই অন্যদের কাজ। রাবণজয়ের পর রাম যেমন বানরদের লঙ্কায় ফেলে পুষ্পকবিমানে হুস করে অযোধ্যা উড়ে গিয়েছিলেন, নেতারাও অমনি সঙ্গীদের পায়ে দলে দিল্লি গিয়ে ক্ষমতা লোটেন।
উপনির্বাচনের ফল দেখে বিজেপি নেতারা যখন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তুলছেন, সেই সময় এমন কথা শুনে নিশ্চয়ই চিড়বিড় করে উঠেছিলেন যোগী। কিন্তু কী আর করা, সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টির এই নেতাটির গুরুত্ব অনেক, তাই উত্তরপ্রদেশে যাদব ছাড়া অন্যান্য পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর ভোটের দিকে তাকিয়েই তাঁকে সে দিন চুপ করে থাকতে হয়েছিল।
বিপদে পড়ে যোগী এ হেন সংযম দেখালেও গত চার বছর বিজেপি নেতারা অবশ্যই তা দেখাননি। হয়তো ভাবতেই পারেননি, ‘বিপদ’ আসতে পারে। ২০১৪ সাল থেকে তাঁদের নিপাট নিশ্ছিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার গল্পের ভাঁজে যে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সমাজ-চিত্রের বিভিন্ন জটিল বাস্তব লুিকয়ে আছে, ভাবেননি সে কথা। গোষ্ঠী-রাজনীতির এত রকমভেদ, এত প্রকার আইডেন্টিটির দাপট— সব মিলিয়ে ওই গরিষ্ঠতায় পৌঁছনো এবং সেটা ধরে রাখা কম ঝামেলার কাজ নয়। ২০১৪ সালের এনডিএ থেকে শুরু করে একের পর এক বিধানসভা নির্বাচন: ক্ষমতার তাগিদে বিজেপিকে বার বার ওই আইডেন্টিটিদের তুষ্ট করতে হয়েছে, আঞ্চলিক দলের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছে। শরিক ছাড়া বিজেপির চলেওনি, চলবেও না, অথচ সব ভুলে তারা মেতে থেকেছে ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’র বড়াইয়ে।
এতগুলো দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে যে রীতিনীতি বা রাজনীতির যে প্রকৃতি দরকার হয়, কোনওটাই বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বের জিন-এ নেই। দলের মধ্যেই কাউকে পাত্তা দেন না নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ, তায় আবার দলের বাইরে। তাঁদের ভাবটা হল: কেন্দ্রে যারা ২৮২টা আসন পায়, রাজ্যগুলোও আস্তে আস্তে তারা পকেটে পুরতেই পারে, শরিকদের এত ট্যাঁফো কিসের। উল্টো দিকে শরিকদের কেন্দ্র নিয়ে মাথাব্যথা কম, তাদের প্রথম চাহিদা: নিজের নিজের রাজ্যে গুরুত্ব পাওয়া, রাজ্যের ভোটারদের তুষ্ট রাখা।
সব মিলিয়ে, ২০১৪ সাল থেকে যে আঞ্চলিক দলগুলো বিজেপির সঙ্গ নিয়েছিল, প্রায় সকলেই ইতিমধ্যে চটে আগুন। বানরসেনার উদাহরণটা মোক্ষম দিয়েছেন ওমপ্রকাশ। অন্য দলগুলিও ছেড়ে কথা কইছে না। পঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দল বিজেপিকে দাদাগিরি ছাড়তে বলেছে। বিহারে জেডি(ইউ) বিজেপিকে হুমকি দিয়েছে নীতীশ কুমারকে জোটের মুখ করতেই হবে। এনডিএ-র আর এক শরিক দল, লোক জনশক্তি মোর্চার নেতা চিরাগ পাসোয়ান (রামবিলাস পাসোয়ানের ছেলে) কয়েক মাস আগে বিজেপিকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, শরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করতে, নয়তো ২০১৯ সালে গেরুয়া পার্টি ডুববে। (রামবিলাস অবশ্য দু’দিন আগে প্রেস কনফারেন্স ডেকে এনডিএ-বিচ্ছেদ সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।) অন্ধ্রের শরিক তেলুগু দেশম তো অনেক দিন ধরেই রাজ্যের ‘স্পেশাল স্টেটাস’-এর দাবিতে বিরাট চাপ তৈরি করে রেখেছে, রাজ্য রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় এনডিএ ছেড়ে বেরিয়েও এসেছেন চন্দ্রবাবু নায়ডু। দিনকাল এমন যে গোয়ার মতো লিলিপুট রাজ্যেও বিজেপি সরকারের রক্তচাপ ক্ষণে ক্ষণে বাড়িয়ে তুলছে ছোট মাপের আঞ্চলিক শরিক, মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক দল এবং গোয়া ফরওয়ার্ড পার্টি। বক্তব্য তাদের পরিষ্কার, আমাদের তিন+তিন বিধায়ক ছাড়া তোমরা সরকার গড়তেই পারতে না, ফলে আমাদের দাবিও তোমাদের মানতে হবে। ২০১৭ সালে গোয়ার বিধানসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে এদের সমর্থনেই সরকার গড়েছিল বিজেপি, অথচ তার পর থেকে এদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। দাম দিতে হচ্ছে এখন।
ঠিক একই যুক্তি ও বিরক্তিতে ফেটে পড়ছে মহারাষ্ট্রের শরিক দলটি। ২০১৪-য় বিধানসভা নির্বাচনের পর সে রাজ্যেও বিজেপিকে সরকার গড়ার জন্য শরিকের দ্বারস্থ হতে হয়, শরদ পওয়ারের এনসিপি ও উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার মধ্যে দ্বিতীয়কেই ‘লক্ষ্মণ দোসর’ হিসেবে বেছে নেন অমিত শাহ। কী ভুলই না হয়েছিল! গত চার বছরে ‘বন্ধু’ শিবসেনা যে পরিমাণ বেগ দিয়েছে তাঁদের, কোথায় লাগে ‘শত্রু’রা! প্রতিটি বিষয়ে দুই দলের খটাখটি। শিবসেনার কোনও দাবি মেটায়নি বিজেপি, বিজেপির কোনও সিদ্ধান্তে পাশে দাঁড়ায়নি শিবসেনা। গত জুনে ক্যাবিনেট বৈঠক পর্যন্ত বয়কট করেছে শিবসেনা— বিজেপি নাকি বিরোধীদের থেকেও কম পাত্তা দেয় শরিককে, ‘পোকামাকড়ের মতো’ দেখে! শিবসেনার মুখপত্র ‘সামনা’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় রাউত এপ্রিল মাসে দুই দলের তালাক ও ডিভোর্সের কথাও তুলেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ যখন প্রবল আকার ধারণ করল সে রাজ্যে, সরকারে থেকেও শিবসেনা প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছে। এ বারের পালঘর উপনির্বাচনে শিবসেনা আলাদা ভাবে লড়েছে, স্বভাবতই তাতে দুই দলই প্রত্যাশার চেয়ে কম ভোট পেয়েছে।
গল্পটা আরও জমাট হয়, শিবসেনার বিজেপি-বিরোধিতার পরতে পরতে আঞ্চলিক আবেগের প্রয়োগটা লক্ষ করলে। তাদের অভিযোগ: বিজেপি মরাঠিদের জন্য কিছু করে না। মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস নাকি নানার রিফাইনারি প্রকল্পে বেছে বেছে গুজরাতি ও মারওয়াড়িদের জমি দিয়েছেন, বাদ দিয়েছেন মরাঠিদের। আসল কথাটা হল, যে হেতু একই হিন্দুত্ববাদী সমর্থকগোষ্ঠীর কাছে দরবার করতে হয় দু’টি দলকে, হিন্দুত্বের সঙ্গে মরাঠি অস্মিতার গল্প সমানে মিলিয়ে চললে তবেই শিবসেনার পক্ষে ভোট বাড়ানো সম্ভব হতে পারে। এই আঞ্চলিক সত্তা-রাজনীতিই বলে দেয়, কেন মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরে অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নায়ডুর প্রতি এতখানি সদয়। উদ্ধবের মাতোশ্রী ভবন থেকে বহু বার শুভেচ্ছা গিয়েছে তেলুগু দেশমের কাছে, বিজেপি-বিরোধী অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। তেলুগু অহঙ্কারের সঙ্গে কোনও আপস নয়— বার্তা গিয়েছে বার বার। এই যে আঞ্চলিক সত্তা-রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, অমিত শাহরা তাকে বাগ মানানোর কায়দাটা এখনও ঠিক বুঝে ওঠেননি। শরিক-সম্পর্ক-রচনায় গভীর ব্যর্থতার রহস্য ওটাই।
গত পরশু অমিত-উদ্ধব বৈঠকের পরও তাই শোনা গেল পূর্ব সিদ্ধান্তে স্থির শিবসেনা, ২০১৯ সালে তারা নাকি একার সামর্থ্যেই ভোটের মাঠে নামবে। অর্থাৎ হিন্দুত্ব ভোট সে রাজ্যে আবারও ভাগ হবে। দুর্ভাবনা কি কুরে কুরে খাচ্ছে দিল্লির দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের অফিসকে! শরিক-নীতির ব্যর্থতাই কি তবে মোদীর কাল হতে চলেছে?
কথাটা সরল ও স্পষ্ট হলেও ছাপ্পান্ন ইঞ্চির অহঙ্কারে তা বুঝতে এত দেরি হল। দিনকাল বদলেছে, একদলীয় শাসনের যুগ শেষ। এই ভারতের সাগরতীরে এখন শরিক বিনে গীত নেই। শরিক-ভজনা আজ রামভজনার থেকে অনেক জরুরি। অনেক দিন আগে, অন্য এক প্রেক্ষিতে, এনডিএ প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী মোদীকে উপদেশ দিয়েছিলেন রাজধর্ম পালন করতে। এখনকার প্রধানমন্ত্রী মোদীর উদ্ভ্রান্ত অহংবাদ দেখলে কী বলতেন তিনি? হয়তো বলতেন, তিষ্ঠ বৎস, স্থানকাল এবং পাত্র বিস্মৃত না হয়ে ‘শরিক-ধর্ম’ পালন করো। প্রসঙ্গত, বাজপেয়ী সরকারে বিজেপির আসনসংখ্যা ছিল অনেক কম, তাঁকে অনেক বেশি নির্ভর করতে হত শরিকদের উপর। নিয়মিত শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসতেন তিনি, বাড়তি গুরুত্ব দিতেন তাদের।
গত চার বছরে সেই উদ্যম বা উদ্যোগের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। শিবসেনার প্রশ্ন তাই সঙ্গত: কেন চার বছর পর বৈঠকে বসার প্রয়োজন অনুভব করলেন অমিত শাহ। বুধবার মুম্বইয়ে উদ্ধব ঠাকরের বাড়ি, বৃহস্পতিবার চণ্ডীগড়ে প্রকাশ সিংহ বাদলের বাড়ি: ‘আপৎকালে শরিক-নাম’ করাটাকে তো ঠিক ‘শরিক-সহযোগিতা’ বলা চলে না। মনে পড়ে অন্য এক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই মহোক্তি: বিপদে পড়ে ‘অস্বাভাবিক উচ্চস্বরে আত্মীয় বলিয়া ভাই বলিয়া ডাকাডাকি’ শুরু করলেও কেন যে ‘তাহারা অশ্রুগদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না!’