সম্প্রতি শোনা গেছে, তেলেভাজার দোকান থেকেও চার-ছ’তলা বাড়ির মালিক হওয়া সম্ভব। ব্যাপারটা কিন্তু পরিহাসের নয়, দুঃখের তো নয়ই। তেলেভাজারই সমগোত্রীয় কচুরি-নিমকি, বড়জোর তার সঙ্গে লস্যি বিক্রি করে ফুটপাতের ছোট্ট দোকানঘর থেকে রীতিমত বিক্রয়ের রসিদ দেওয়া পনেরোশো স্কোয়্যার ফিটের প্রশস্ত দোকানে উত্তরণ এ শহরে বিরল নয়। ব্যাঙ্কঋণ, লাইসেন্স ব্যবস্থার সুবিধে যেমন বেড়েছে, প্রদেয় কর, রাজনৈতিক দক্ষিণাও তেমনই বেড়েছে। এমন উত্তরণের ফলে ব্যক্তি থেকে রাজ্য, সবারই সরাসরি উন্নতি হয়। তা হলে কেন আরও আরও বেশি করে বদলাচ্ছে না শহরের এবং রাজ্যের চালচিত্র? কেন বছরের পর বছর লাল-নীল-হলুদ নোংরা প্লাস্টিকে মুখ ঢেকে থাকে গড়িয়াহাট থেকে শ্যামবাজার? কেন জেলা শহরগুলোর এমন হতশ্রী চেহারা? সমস্যাটা পশ্চিমবঙ্গের একার নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা তো কোনও সান্ত্বনার উপকরণ হতে পারে না! পুরভোটের এই মরসুমে একটু ভেবে দেখা দরকার নয় কি?
কলকাতায় বিভিন্ন মেট্রো স্টেশনের মুখ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ফল (কাটা বা গোটা), পান-সিগারেট, খেলনা কিংবা বিরিয়ানির ‘স্টল’। প্লাস্টিকের পার্মানেন্ট ছাউনি সমেত। কোনও দিন যদি তাড়াহুড়ো করে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হয় মেট্রোর গেট দিয়ে, একটা বড় রকমের দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রবল। রাসবিহারী মোড়ের মতো কিছু জায়গায় তো ফুটপাত ছাড়িয়ে বেসাতি রাস্তায় নেমে এসেছে। মনে হয়, খুব শিগগিরই ডিভাইডার পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এ-রকম নজির এ শহর এবং রাজ্যের মানুষ ভূরি ভূরি দিতে পারেন। তার পর ধরুন, কলকাতার প্রধান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দরজা, এমনকী বাড়ির অংশ একটু দূর থেকে দেখতে পাবেন না। ঘুগনি, আলুর দম, চাউমিনের দোকানে দেওয়াল সম্পূর্ণ ঢাকা। বাঙালি মেনে নিয়েছে, মানিয়ে নিয়েছে।
এবং, বহু নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিক ভাবে উপেক্ষা করা ছাড়াও এই মেনে নেওয়ার মধ্যে বাঙালির গত তিন দশকের অশিক্ষা আর বেনিয়ম ঠিকরে বেরোচ্ছে। বাসে চার জনের সিটে ‘সরুন সরুন’ করে জোর করে পাঁচ জন বসার মতো। পুরসভা আর পুলিশ যৌথ তত্পরতায় এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে এই ধরনের পরিবেশ নির্ধারণ করে দেয়, আপনি ডামাডোলের মধ্যে থাকবেন, জীবিকা নির্বাহ করবেন, না কি ‘পা দিয়ে ভোট দেবেন’, অর্থাত্ কেটে পড়বেন। তা, বাঙালি সুযোগ পেলেই কেটে পড়ছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু ভাল করলেই দক্ষিণ বা পশ্চিমের শহরগুলোতে কাজের অভাব হয় না। সেখানে লোডশেডিং আছে, জলকষ্ট আছে, গোড়ালির চাঁট মেরে ধুতিকে লুঙ্গি করা আছে, এমনকী অটো রিকশাও আছে, তবু বোধহয় প্রাত্যহিক জীবন যাপনের ভাল শর্তগুলি অনেকটাই পূর্ণ হয়।
এ বার, মনে করুন, সরকারের হকার লাইসেন্স নীতি কলকাতার এই বেআইনি ব্যবস্থাটাকে আইনি সিলমোহর দিয়ে দিল। যত বিবেচনা সহকারেই সরকার এ নীতি প্রয়োগ করুক, এই ঘোষণাটুকুর টানেই হকারের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এ জিনিস অন্যত্র ঘটেছে। নাইরোবিতে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা কমাতে কেনিয়া সরকার এক বার কিছু লোকের চাকরির বন্দোবস্ত করে দেয়। খবর পেয়ে কয়েক দিনের মধ্যে আরও লাখখানেক লোক চলে আসে গ্রাম থেকে। শহরে বেকারত্ব দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তার পর ফুটপাতবাসীদের পার্ক দখল করে বসতি, কিংবা রাস্তার কোণে কোণে দোকান দেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। কলকাতায় তা দাঁড়ায় আদিগঙ্গার পাশে সরকারি জমিতে টিনের চালের পাকা বাড়ি কিংবা রেল প্ল্যাটফর্মের নীচে প্লাস্টিক। অর্থাত্ কলকাতার কিছু অংশ লন্ডন হবে, বাকিটা লন্ডভন্ড। আপনার পুর-নির্বাচনী ইস্তাহার কী বলছে?
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক