কেন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কৈশোর

কৈশোর অনেক সময়ই আবেগ দ্বারা, কৌতুহল দ্বারা পরিচালিত হয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ধর্মীয় উন্মাদনা ইত্যাদি সহজেই তাদের মনোজগতে আলোড়ন তৈরি করে। এর ফলে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ কিশোর-কিশোরীরাও জড়িয়ে পড়ে নানান অসামাজিক কাজে। কৈশোর কালের মনোজীবন বোঝার চেষ্টা করলেন অরিত্র চক্রবর্তী।

Advertisement

অরিত্র চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৯
Share:

শৈশব থেকে যৌবনে উত্তরণের মাঝের ধাপ হল কৈশোর। এই সময় শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বিকাশও ঘটে। পরিবর্তন হয় পরিবার ও সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির। আজকের কিশোর কিশোরীরাই ভবিষ্যতের নাগরিক। কিন্তু বর্তমানে প্রায়ই আমরা দেখতে পাচ্ছি কিশোর-কিশোরীরা নানা ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। যার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন হায়দরাবাদে তরুণীর গণধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন, যে বয়সে ক্ষুদিরামের মতো বিপ্লবীরা দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন সেই কিশোর বয়সেই এখনকার প্রজন্মের কিছু কিশোর-কিশোরী অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ছে কেন?

Advertisement

কিশোর-কিশোরীদের চিন্তাভাবনা আর প্রাপ্তবয়স্কদের চিন্তা ভাবনার মধ্যে কিন্তু যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কৈশোর অনেক সময়ই আবেগ দ্বারা, কৌতুহল দ্বারা পরিচালিত হয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ধর্মীয় উন্মাদনা ইত্যাদি সহজেই তাদের মনোজগতে আলোড়ন তৈরি করে। আর এর ফলে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ কিশোর- কিশোরীরাও জড়িয়ে পড়ে নানান অসামাজিক কাজে।

এ তো গেল প্রাথমিক একটি সম্ভাবনা। বিষয়টি আরেকটু তলিয়ে দেখলে বুঝব, কৈশোর হল বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সময়। ভাল বন্ধু যেমন ভাল আবহ, সুস্থ প্রতিযোগিতা, মানসিক উন্নয়নের কারণ হয়, তেমনই খারাপ বন্ধু তাকে বিপথগামী করে। আবার যে সব কিশোর-কিশোরীর তেমন কোনও বন্ধুই নেই তারা নিজেদের প্রমাণ করার জন্য নানান ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দেয় ও অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেলে।

Advertisement

অনেক সময় এই বিপথগামী হওয়ার পিছনে পারিবারিক কারণও থাকে। বাবা-মায়ের ও পরিবারের সদস্যদের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়া, বাবা বা মায়ের পুনর্বিবাহ, পারিবারিক কলহ, নিয়ামানুবার্তিতার অভাব, অতিরিক্ত শাসন বা শাসনের অভাব, পারিবারিক সদস্যদের নেশা করার প্রবণতা, শারীরিক, মানসিক ও যৌন উৎপীড়ন ইত্যাদি কিশোর-কিশোরীদের এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, ক্ষুধা সংবলিত শহরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মনুষ্যেতর জীবনযাপন যেমন অনেকসময় কিশোর মনে অসামাজিকতার বীজ বপন করে, তেমনই উচ্চবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করা কিশোর-কিশোরীও অর্থ ও ক্ষমতার গর্বে অন্ধ হয়ে ভুল পথে চালিত হয়।

কোনও কিশোর বা কিশোরী নেশার জালে জড়িয়ে পড়লে সে নিজের ভাললাগার কাজগুলি না করে, নিজের পড়াশোনা ও কাজ কর্মের ক্ষতি করে। ক্রমশ নেশাদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ বাড়তে থাকে ও নেশা না করলে তার অস্বস্তি হতে থাকে। নেশাদ্রব্য কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য সে অনেক সময় বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে বা অন্য কোনও অসৎ উপায় অবলম্বন করে। এই ভাবে ওই কিশোর ধীরে ধীরে নেশার দুষ্টচক্রের মধ্যে তলিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, নেশা আমাদের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাই নেশার ঘোরে, কৈশোরের উন্মাদনায় বাস্তব বুদ্ধি হারিয়েও অনেকসময় তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।

আবার বিভিন্ন সংবাদপত্র, টেলিভিশন, ফেসবুক ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় বিবৃত বিভিন্ন অপরাধের বিবরণ বা ভিডিও কিশোর-কিশোরীদের মনে গভীর ছাপ ফেলে, সেখান থেকেও অনেক সময় তারা বিপথে চালিত হতে পারে।

অনেকসময় শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের কিছু মানসিক সমস্যা থাকলে তাদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। অ্যাটেনসন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) হল একপ্রকার মানসিক রোগ যার লক্ষণগুলি হল মনযোগের অভাব ও অতি চঞ্চলতা। বড় হওয়ার সঙ্গে এই রোগের লক্ষণগুলি সংখ্যায় কমলেও কিছু সমস্যা থেকেই যায় যা কর্মক্ষেত্রে নানান বাধা সৃষ্টি করে।

আবার কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার নামক রোগের মূল লক্ষণগুলি হল-অসামাজিক আচরণ, নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করা, ঔদ্ধত্য, পশুপাখি বা অন্য মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন, অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা, মিথ্যে কথা বলা, স্কুল থেকে পালানো, চুরি করা ইত্যাদিI। এই রোগ ছোট থেকে শুরু হয়। উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে এরা কৈশোর অবস্থা থেকেই বা বড় হয়ে নানান অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। অনেকসময় এইরকম একই মানসিকতার কিছু কিশোর-কিশোরী দলবেঁধে অপরাধ করে।

এই মানসিক সমস্যাগুলি সম্পর্কে অনেক অভিভাবক বা শিক্ষক-শিক্ষিকাই বিশেষ ভাবে অবগত নন। তাই এই সব বিষয়ে তাঁদের অবগত করা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। উপরে বর্ণিত মানসিক সমস্যাগুলি থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়া অবশ্যই দরকার। কিন্তু অপরাধ প্রবণতা কমানোর চেষ্টা করা বোধ হয় আরো বেশি দরকার। বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে বাচ্চার সুসম্পর্ক থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কৈশোরের চাহিদা বুঝে সেই অনুযায়ী অভিভাবকদের যত্নশীল আচরণ করতে হবে। ভয়হীন ভাবে বাবা-মাকে মনের কথা খুলে বলতে পারলে কিশোর-কিশোরীরা সহজেই অনেক মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে। শারীরিক-মানসিক বা যৌন উৎপীড়নের ঘটনা ঘটলে বা হঠাৎ করে বাচ্চার ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার।

দরিদ্র শিশু-কিশোরদের উপযুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন নেশা দ্রব্যের জোগান বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলোকে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের উপযোগী ও শিক্ষামূলক নানান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে। বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনাগুলির বিবরণ প্রকাশের ব্যাপারে সাংবাদমাধ্যমগুলিকেও যত্নশীল হতে হবে। কারণ অপরাধ সংগঠনের বিস্তারিত বিবরণ ভবিষ্যতে একই ধরনের অপরাধ ঘটানোর রাস্তা প্রশস্ত করে।

লেখক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement