বেলা আড়াইটে। এক হাতা করে সয়াবিন-আলুর ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে পড়ুয়ারা ফিরে এসেছে ক্লাসে। রোদ সরে গিয়েছে সামনের মাঠে, ক্লাসঘরে এখন আবছায়া। শিয়াল আর মুরগিছানার গল্পের অক্ষরগুলো ঠাহর করতে ছোট ছোট শরীরগুলো উপুড় হয়ে পড়েছে পাতার উপর।
না কি সামনের রোদ-ভরা মাঠের চাইতেও উজ্জ্বল ওই ক্লাসঘর? মালদহের সাতঘরিয়া পিপি প্রাইমারি স্কুলের ওই ক্লাসে বসেছিল স্কুলের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির সেই পড়ুয়ারা, যারা এখনও ‘রিডার’ হয়ে উঠতে পারেনি। অর্থাৎ অক্ষর, শব্দ ছাপিয়ে বাক্য, প্যারাগ্রাফ অবধি পৌঁছতে পারেনি। স্কুলের প্রথম দুই বছরেই অবশ্য ওটুকু শিখে যাওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি সমীক্ষা বলছে, মালদহে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেও ৪০ শতাংশ ছেলেমেয়ে পড়তে পারে না, চতুর্থ শ্রেণিতে ৩০ শতাংশ। দুই মেদিনীপুর, কলকাতা আর নদিয়া বাদ দিলে গোটা রাজ্যের চেহারা প্রায় এমনই।
সাতঘরিয়ার স্কুল মাস্টারমশাই বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে জানালেন, দেড় মাসেই এই শিশুরা তাদের ক্লাস-উপযোগী লেখাপড়া করতে পারবে। ক্লাসে খানিকক্ষণ বসে বোঝা গেল, ‘কেউ বাদ থাকবে না’, এই হল নীতি। সকলকেই কিছু না কিছু বলতে হবে। ‘তুমি শেয়াল দেখেছো?’ কিংবা ‘ছবিতে মুরগিটা কী করছে?’ এমন প্রশ্ন থেকে শুরু। গল্প পড়ার সময়ে সঙ্গে থাকে অক্ষরের চার্ট। গল্পে কোনও অক্ষর চিনতে না পারলে ‘কা কি কী কু কূ’-লেখা চার্ট থেকে মিলিয়ে দেখে নিতে হবে। ঠিক বললেই হাততালি। শিক্ষক বলে দিচ্ছেন না। ছাত্রদের দিয়ে বলিয়ে নেওয়া, পড়িয়ে নেওয়াই শিক্ষকের কাজ।
পাশের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরে আবার পিছিয়ে-পড়া পড়ুয়াদের নিয়ে প্রকল্পের চেহারাটা অন্য রকম। সেখানে মাসে টানা ১০ দিন ক্যাম্প স্কুলে, মোট তিন বার। যে অক্ষর বা শব্দটুকু পড়তে পারে, তাকে বাক্য পড়ার স্তরে, যে বাক্য পারে তাকে প্যারাগ্রাফ পড়ার স্তরে উন্নত করা চলছে। অঙ্কতেও তেমনই সংখ্যা পরিচয় থেকে বিয়োগ, বিয়োগ থেকে ভাগে উন্নত করা হচ্ছে তিন মাসে। জন্মাষ্টমীর ছুটিতেও সব ছেলেমেয়ে চলে এসেছে, স্কুলের জামা পরে। মিড ডে মিল নেই, তবুও। ভারতের নানা রাজ্যে অসরকারি সংস্থা ‘প্রথম’ দেখেছে, ক্যাম্পের গোড়ায় গড়ে ২৫ শতাংশ পড়তে-না-পারা পড়ুয়া থাকে। তিন-চারটে ক্যাম্পের শেষে তা দাঁড়ায় সাত-আট শতাংশে।
তা হলে সব স্কুলের সব শিক্ষক এমন ভাবেই পড়ান না কেন?
‘ছোট গ্রুপ, বড় গ্রুপ করে পড়া, খেলনার মতো জিনিস দিয়ে শেখানো, এগুলো কর্মরত শিক্ষকদের জন্য সরকারি ট্রেনিংয়েও শেখানো হয়,’ বললেন এক শিক্ষিকা। দু’বছর আগে তাঁর সে ট্রেনিং হয়েছে। এত দিন ওই ভাবে শেখাননি কেন? ‘আসলে তিন দিনের ট্রেনিং তো। প্রথম প্রথম করাতাম। তার পর আর ...’ বহু স্কুলে ‘টিচিং-লার্নিং মেটিরিয়াল’ অফিস ঘরেই তালাবন্দি হয়ে পড়ে থাকে। প্রায় কোনও স্কুলে যে বাস্তবিক প্রশিক্ষণে-শেখা পদ্ধতিতে পড়ানো হয় না, তা শিক্ষাকর্তারাও স্বীকার করেন। যদিও প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য রাজ্য সরকার খরচ করে বছরে ৩ কোটি টাকা, প্রশিক্ষণ সংস্থার জন্য ছ’কোটি টাকারও বেশি। নানা শিক্ষকের সঙ্গে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলে দেখা গেল, পার্থক্য নতুন পদ্ধতির জন্য অতটা নয়, যতটা ‘প্রথম’ কর্মীদের নিয়মিত ‘ভিজিট’-এর জন্য।
এখন নজরদারির ব্যবস্থা কী?
এক কথায়, কিস্যু না। স্কুলে গিয়ে দেখার কথা স্কুল ইনস্পেক্টরদের। মালদহে এক-এক জনের অধীনে সত্তরেরও বেশি স্কুল। কেউ আবার আরও একটি সার্কল-এর বাড়তি দায়িত্বে আছেন। বহু স্কুল বছরে এক বারও পরিদর্শন হয় না। পরিদর্শনে ফাঁকি ধরা পড়লেও ইনস্পেক্টরের ক্ষমতা সামান্যই। ‘কারণ দর্শানো’ অবধি। ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের। এক ইনস্পেক্টর বলেন, ‘আমরা জেলা কাউন্সিলকে রিপোর্ট দিই। তাঁরা কিছুই করেন না। শিক্ষক সংগঠনরাই সব নিয়ন্ত্রণ করে।’
কী বলছে শিক্ষক সংগঠন? প্রশ্নটা তুলতেই ফুঁসে উঠলেন নেতা-শিক্ষকরা। এক জন বললেন, ‘করে দেখাক তো শো-কজ? যে টিচারগুলো নড়বড়ে, পিছনে কেউ নেই, তাদেরকেই ওরা ও সব করতে সাহস পায়।’ কিন্তু শিক্ষকরা যদি ক্লাসে না আসেন, তা হলে চিঠি দেওয়াই উচিত নয় কি? ‘লিখে রাখুন, ৯৯ শতাংশ শিক্ষক সময় মতো আসেন।’
গবেষকদের সমীক্ষা অবশ্য তা বলছে না। বিশ্বব্যাঙ্কের একটি রিপোর্ট ২০০৫ সালে বলেছিল, এ রাজ্যে গড়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষক স্কুলেই আসেন না। যাঁরা আসেন, তাঁদেরও প্রায় অর্ধেক ক্লাসে পড়ান না। এখন কি ছবিটা বদলেছে? শিক্ষা দফতরের কর্তারাই বিলক্ষণ চটে আছেন শিক্ষকদের উপর। ‘মিড ডে মিলের পর ক’টা স্কুল খোলা থাকে?’ আড়ালে বললেন এক জন। তাঁর আন্দাজ, জেলার ১৯০০ স্কুলের মধ্যে হাজার দেড়েকই ছুটি হয়ে যায় আড়াইটে না-বাজতে। ক্লাস হওয়ার কথা চারটে অবধি। আবার স্কুলে এসেও ক্লাসে যাচ্ছেন না অনেক শিক্ষক। স্টাফরুমে শিক্ষকেরা বসে, ক্লাসে পড়ুয়ারা হট্টগোল জুড়েছে, এ-ও আজ পরিচিত দৃশ্য।
সেই ফাঁক ভরতে এগিয়ে আসছে বেসরকারি স্কুল। মালদহে এখন ১৩০০ প্রাইভেট স্কুল। সেখানে যারা যায়, তাদের অধিকাংশেরই নাম লেখানো থাকে সরকারি স্কুলেও। কিন্তু তারা ক্লাসে আসে না। শুক্রবার মিড ডে মিলে ভাতের সঙ্গে ডিম দেওয়া হয়। খাপে খাপ মিলিয়ে বেসরকারি স্কুল সেদিন ছুটি থাকে। সে দিন সরকারি স্কুলে উপস্থিতি একটু বাড়ে। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে দেখা গেল, আরও ভাল ‘ফিট’ হয়েছে দুটো ব্যবস্থায়। বেসরকারি স্কুল চলে সকাল সাড়ে দশটা অবধি। সরকারি স্কুল শুরু এগারোটা থেকে। চাতরায় দেখা হল দুই মহিলার সঙ্গে। নিজেরা বেসরকারি স্কুলের দিদিমণি, সঙ্গের শিশু দুটি পড়ে দুটো স্কুলেই। ‘টাকা না দিলে কি জিনিস মেলে?’ প্রশ্ন তাঁদের। প্রাইভেট স্কুলকে মাসে দেড়শো টাকা দক্ষিণা দিয়ে বিদ্যালাভের স্বপ্ন দেখেন গরিব বাপ-মা। সরকারি শিক্ষকরা ব্যঙ্গ করেন। ‘ওরা ভাবে টাই দুলিয়ে স্কুলে গেলেই হল। কী পড়াচ্ছে, তা ওরা বোঝে?’
সত্যিই বোঝে না। বেসরকারি স্কুলেও লেখাপড়ার দক্ষতা তৈরি হয় সামান্যই। সেখানে শিক্ষকরা বোর্ডে যা লেখেন, মুখে যা বলেন, তোতাপাখির মতো বলে শিশুরা। গোটা কবিতা মুখস্থ, কিন্তু তার একটি শব্দও আলাদা করে পড়তে, লিখতে পারে না। মানে জানে না, প্রয়োগ তো দূরের কথা। টিউশনেও সেই দশা। একটি অসরকারি সমীক্ষা বলছে, এ রাজ্যে প্রাথমিকের ছাত্রদের অর্ধেকেরও বেশি প্রাইভেট টিউশন নেয়, কিন্তু চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেও ৩৭ শতাংশ প্রথম শ্রেণির পাঠ্য পড়তে পারে না। যা ফ্রি-তে পাওয়ার কথা, টাকা দিয়েও তা মেলে না— গরিবের জন্য বিদ্যা এমনই দুর্লভ।
অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ভারতে গরিব শিশুর শিক্ষার অধিকার আসলে মধ্যবিত্তের শিক্ষকের চাকরি পাওয়ার অধিকার। কথাটার সত্যতা যেন গায়ে বেঁধে। অধিকার হল তা-ই, যা নিঃশর্ত। কথা ছিল, জাত-লিঙ্গ-সচ্ছলতা— শিশুশিক্ষা থেকে সব শর্ত অপসারিত হবে। দেখা যাচ্ছে, সে সব শর্ত এখনও প্রায় অর্ধেক ছেলেকে স্কুল শেষের আগেই স্কুলের বাইরে রেখে আসছে। অন্য দিকে, সময়ে ক্লাসে আসা, পুরো সময়টা স্কুলে থাকা, প্রশিক্ষণ অনুসারে পড়ানো, ছাত্রের ন্যূনতম দক্ষতা তৈরি, কোনও শর্ত পূরণ না করেও এক জন শিক্ষক গোটা কর্মজীবনে কাটিয়ে পেনশন পেতে পারেন।
তার মানে এই নয় যে সবাই তা-ই করছেন। কেউ কেউ প্রত্যাশার বাইরে গিয়েও কাজ করেন। মালদহেরই দৈবকীপুরে দেখা মিলল এমন স্কুলের, যেখানে শিক্ষকরা স্থানীয় গ্রামবাসীকে জড়িয়ে নিয়ে স্কুলটি অপরূপ করে তুলেছেন। ছাত্রদের উপস্থিতিও বেড়েছে। তাতে এটুকুই বোঝা যায় যে, গরিব শিশুকে স্কুলে আনা যায়, শেখানোও যায়।
কিন্তু তা অধিকাংশ স্কুলে হচ্ছে না, হবেও না। কারণ ছাত্রের দক্ষতা তৈরির শর্ত সরকার শিক্ষকদের উপর আরোপ করেনি।
রাজ্য সরকার স্কুল শিক্ষা খাতে যত টাকা খরচ করে, তার ৯০ শতাংশ যায় শিক্ষকদের বেতনে। কিন্তু যিনি ভাল পড়ান, আর যিনি ফাঁকি দেন, তাঁদের তফাত ধরার কোনও উপায়ই নেই সরকারি ব্যবস্থায়। শিক্ষকদের ‘অ্যানুয়াল পারফর্ম্যান্স রিপোর্ট’ তৈরি করার কথা আছে প্রাথমিক শিক্ষা আইনে। তা করা হয় না। ছাত্রদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের ফল জেলা বা রাজ্য শিক্ষা দফতরে থাকে না। এমনকী মাধ্যমিকের ফলেরও স্কুলওয়াড়ি বিশ্লেষণ হয় না। কোন কোন স্কুল ক্রমাগত খারাপ করছে, সে ছবি মেলা অসম্ভব। গোটা ব্যবস্থাটায় শিক্ষকের প্রতি প্রশ্রয়ের ছাপ স্পষ্ট।
সে প্রশ্রয় এমনই যে, যেটুকু শর্ত রয়েছে তা-ও ঢিলে হচ্ছে। নিয়োগের জন্য ট্রেনিংয়ের শর্ত তুলে দিতে চেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। আদালত তাতে ব্রেক কষেছে। জেলার বাইরে শিক্ষক বদলিও এ বার নিষিদ্ধ হচ্ছে। যদিও ঘটনা হল, জেলার মধ্যেও বদলি করতে ব্যর্থ সরকার। শহর থেকে দূরে যেতে কত অনিচ্ছুক শিক্ষকরা, তা একেবারে ম্যাপে ফেলে দেখা যায় মালদহে। ইংরেজবাজার পুরসভা এলাকায় শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ১:২২। ক্রমশ পশ্চিমে সরলে, রতুয়া ২ ব্লকে ৩৮:১, রতুয়া ১ ব্লকে ৪৪:১ আর বিহার-লাগোয়া হরিশচন্দ্রপুর ২ ব্লকে ৫০:১। কার চাহিদাকে প্রাধান্য দিচ্ছে সরকার?
শিক্ষকদের উপর শর্ত চাপাতে চাইলে কী হয়, তারও দৃষ্টান্ত মেলে মালদহেই। বিধানসভা নির্বাচনের পরপর ২২২ জন শিক্ষকের বদলির নির্দেশ দেন জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের তৎকালীন চেয়ারম্যান দিলীপ দেবনাথ। দিলীপবাবুরই বদলির অর্ডার এসেছে সম্প্রতি। ‘এটা প্রত্যাশিতই ছিল,’ বললেন দিলীপবাবু। তবু তাঁর বক্তব্য, ‘এমন আইন করতে হবে যাতে চতুর্থ শ্রেণির ৮০ শতাংশ ছেলেমেয়ে লিখতে-পড়তে না পারলে শিক্ষকের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়।’
মনে পড়ল, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী থাকার সময়ে ব্রাত্য বসু এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, শিক্ষকদের ‘রিওয়ার্ড-পানিশমেন্ট’ প্রথা শুরু করবেন। সে কাজ হয়নি, তিনি সরে গিয়েছেন। প্রাক্তন শিক্ষা সচিব বিক্রম সেন ‘দীপঙ্কর’ প্রকল্প শুরু করেছিলেন, যাতে প্রতিটি শিশুর পড়াশোনা ট্র্যাক করা যায়। সে প্রকল্পের কথা আর কেউ মনেই করতে পারে না। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট বহু আগেই বলেছে, শিক্ষকদের বেতনের একটি অংশ শর্তাধীন করা হোক। তাকেও কেউ পাত্তা দেয়নি। যা কিছু শিক্ষাকে কাগুজে অধিকার থেকে কাজে লাগার জিনিসে পরিণত করতে পারত, তার কোনওটা হয়নি এ দেশে। এ রাজ্যে।
এমনকী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি আমলাদের সার দিয়ে বসিয়ে জনতাকে প্রশ্ন করেন, ‘কাজ কি হয়েছে?’ তিনিও শিক্ষকদের বসিয়ে কখনও অভিভাবকদের প্রশ্ন করেননি, ‘পড়তে-লিখতে কি পারছে?’ শিক্ষক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, স্কুল কমিটি, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কাউন্সিল, সব তাঁর দল দখল করেছে। কিন্তু গরিব শিশুর দখল তৈরি হয়নি বাংলা কিংবা অঙ্কে। চার বছরে তিন হাজার ঘণ্টা স্কুলে কাটিয়েও তারা লিখতে পারে না ‘মমতা।’ বা ‘মোদী।’ কিংবা ‘ভারত।’