সোনার লঙ্কা ছারখার করিতে কিন্তু হনুমান স্বয়ং গিয়াছিলেন— নিজে দুই হাত তুলিয়া পুলিশের গাড়ির নিরাপদ অভ্যন্তরে আশ্রয় লইয়া আশা করেন নাই যে কোনও অনুগত সেনা কাজটি করিয়া আসিবে। সঙ্ঘ পরিবারের লোকজন বোধ করি তেমন মনোযোগ সহকারে রামায়ণ পড়েন না। পবননন্দনের দৃষ্টান্ত হইতে শিক্ষা না লইতে পারাই বিজেপির বৃহস্পতিবারের কর্মসূচিকে শেষ অবধি লঘুক্রিয়ায় পরিণত করিল। কর্মসূচিটি নেহাত বিশৃঙ্খলারই ছিল। অনুমান করা চলে, বামপন্থীদের নবান্ন অভিযানের ‘সাফল্য’ মুরলীধর লেনের নেতাদের এবং তাঁহাদের হাই কমান্ডকে বিচলিত করিয়াছিল। রাজ্যের বিরোধী রাজনীতির পরিসরটি যাহাতে ফের সিপিআইএম-এর দখলে চলিয়া না যায়, তাহা নিশ্চিত করিতে ‘পাল্টা সাফল্য’ অর্জন করা জরুরি বোধ হইয়াছিল। কিন্তু, বিশৃঙ্খলার রাজনীতিরও নিজস্ব ব্যাকরণ আছে। দিল্লি হইতে আসা নেতাই হউন কি স্থানীয় কর্তা, বর্তমান ক্ষমতাধরই হউন অথবা অতীত বা ভবিষ্যতের নেতা— বৃহস্পতিবার প্রত্যেকেই যে ভঙ্গিতে গ্রেফতার হইলেন, তাহা মনে হয় তাঁহাদের উৎসাহী অনুগামীদের মর্মাহত করিয়াছে। নেতারা পলায়ন করিলে বিশৃঙ্খলারও গতিভঙ্গ হয়। বিজেপিও শেষ অবধি একটি পুলিশের গাড়ি জ্বালাইয়া, গোটাকয়েক হাতবোমা ছুড়িয়াই ভঙ্গ দিল। শহিদ হইবার যথেষ্ট সুযোগও নিজেদের জন্য তৈরি করিতে পারিল না। বিরোধী রাজনীতির পরিসরটি কাহার দখলে থাকিবে তাহা অমীমাংসিত, কিন্তু রাস্তার রাজনীতির খেলায় সিপিআইএম-এর সহিত টক্কর দেওয়ার মতো দক্ষতা যে বিজেপি এখনও অর্জন করে নাই, তাহা প্রমাণিত।
যে সপ্তাহে নকশালবাড়ি আন্দোলনের অর্ধশতক পূর্ণ হইতেছে, সেই সপ্তাহের গোড়ায় এবং শেষে কলিকাতার রাজপথ যে দুইটি বিশৃঙ্খলতার রাজনীতির সাক্ষী থাকিল, তাহা কি নিতান্তই সমাপতন? নাকি, বঙ্গীয় রাজনীতিতে এই বালখিল্য হিংস্রতাই মূল স্রোত? ইতিহাস কিন্তু দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির পক্ষে প্রমাণ পেশ করিবে। এবং, এই বালখিল্যতার সূচনা নকশালবাড়ির সময় নহে, তাহার ঢের পূর্বে। বঙ্গীয় রাজনীতি ঐতিহাসিক ভাবেই হিংসাত্মক, এবং সেই হিংসা যথেচ্ছ। এই দীর্ঘ ইতিহাসে সব রাজনীতিই যে গুরুত্বে সমান, অথবা লক্ষ্যে অভিন্ন, কেহ তেমন দাবি করিবেন না। খাদ্য আন্দোলন অথবা ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সহিত বিজেপির লালবাজার অভিযানের তুলনা অবান্তর। এই সপ্তাহেই যে দুইটি দল শহরের রাজপথের দখল লইল, পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে তাহাদের তাৎপর্য সমান নহে। কিন্তু, আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্রের বিপ্রতীপ মেরুতে অবস্থানকারী এই রাজ্যে ‘লড়াই’ করিয়া বাঁচিতে চাহিবার রাজনৈতিক ভাষ্যটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভুলিলে চলিবে না, গাঁধীর রাজনৈতিক আদর্শ এই বাংলার মাটিতে কম মান্যতা পাইয়াছিল।
বামফ্রন্ট এবং বিজেপি, উভয় পক্ষই পশ্চিমবঙ্গে পায়ের নীচে মাটি খুঁজিতেছে। এক দলের অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখিবার লড়াই, অন্য দলের অস্তিত্ব নির্মাণের। এবং, উভয় দলই রাজপথের হিংস্রতাকে নিজেদের পন্থা বাছিয়াছে। বিজেপির উদাহরণটি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সাম্প্রতিক অতীতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাহারা নিজেদের রাজনৈতিক উপস্থিতি জোরদার করিতে লড়িয়াছে। সেই রাজ্যগুলিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিস্তর চেষ্টা হইয়াছে বটে— পশ্চিমবঙ্গেও যেমন হইতেছে— কিন্তু আদ্যোপান্ত এমন বিশৃঙ্খলাসর্বস্ব রাজনীতি অন্য রাজ্যে কমই দেখা গিয়াছে। কারণ, রাজপথের হিংস্রতার এই স্বীকৃতি পশ্চিমবঙ্গে অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি। ইহাই বাঙালির রাজনীতির প্রধানতম ধারা। ফলে, বলা চলে, বিজেপি বাঙালি হইয়া উঠিতে চেষ্টা করিতেছে। হিংস্র বাঙালি।