রাজ্যপাল ‘সন্তুষ্ট’ কি না, আইনের মাপকাঠিতে তাহাই প্রধান প্রশ্ন। রাজ্যের নির্বাচনে কোনও দল বা নির্বাচন-পূর্ব জোট যদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করিতে না পারে, তবে কাহাকে সরকার গড়িতে আমন্ত্রণ জানানো হইবে, তাহা রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত। যে দলের একটি সুস্থায়ী সরকার গড়িতে পারিবার সম্ভাবনায় তিনি ‘সন্তুষ্ট’ হইবেন, সেই দলকে সরকার গড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর অধিকার রাজ্যপালের আছে। সেই দলটির নির্বাচিত বিধায়কের সংখ্যাই সর্বাধিক কি না, তাহা বিবেচনা করিবার বাধ্যবাধকতা রাজ্যপালের নাই। সাম্প্রতিক কালে গোয়া, মণিপুর ও মেঘালয়, এই তিনটি রাজ্যের নির্বাচনে রাজ্যপাল যেমন বিজেপি বা তাহার জোটের সামর্থ্যে ‘সন্তুষ্ট’ হইয়াছিলেন। কোনও রাজ্যেই বিজেপির বিধায়কসংখ্যা সর্বাধিক ছিল না। কর্নাটকে রাজ্যপাল বজুভাই বালাও বিজেপির সামর্থ্যে সন্তুষ্ট হইয়াছেন। যে হেতু জনতা দল সেকুলার লিখিত ভাবে জানাইয়া দিয়াছে যে তাহারা কংগ্রেসের সহিত জোট করিতে চাহে— এবং, সেই জোটে বিধায়কের সংখ্যা ১১৭, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় পাঁচ জন বেশি— অতএব, কোনও সংবিধানসিদ্ধ পথে বিজেপির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্কে পৌঁছানো আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। তাহার পরও যে রাজ্যপাল কংগ্রেস-জেডি(এস) জোটের দাবিতে সন্তুষ্ট না হইয়া বিজেপির দাবিতে হইলেন, দেশবাসী ইহাকে সন্তুষ্ট হইবার এক বিরল ক্ষমতা হিসাবেই বিবেচনা করিতে পারে। অবশ্য সন্তুষ্ট হইবার, না কি সন্তুষ্ট করিবার, সেই তর্কটি অনিবার্য।
সন্তুষ্ট হইবার (বা, করিবার) অধিকার আছে বলিয়া রাজ্যপাল যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত করিতে পারেন কি না— কাকতালীয় ভাবে প্রতিটি সিদ্ধান্তই বিজেপির পক্ষে যাইতেছে— সেই প্রশ্ন উঠিতেছে। প্রশ্নটি আজিকার নহে। ২০০৬ সালে বিহারে তৎকালীন রাজ্যপাল বুটা সিংহের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট কঠোর ভাষায় জানাইয়াছিল, কোনও জোট, এমনকী নির্বাচন-পরবর্তী জোটও, যদি লিখিত ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করিতে পারে, তবে সেই দাবিটিকে অগ্রাহ্য করিবার অধিকার রাজ্যপালের নাই। পরিস্থিতিটি যদি পাল্টাইতে হয়, তবে দুইটি পথ রহিয়াছে। প্রথম পথটি সহজতর, সরকার গঠন বিষয়ে এই গোত্রের অনিশ্চয়তা তৈরি হইলে রাজ্যপালের কী করণীয়, তাহার বিধি বাঁধিয়া দেওয়া। কিন্তু, যদি প্রথা মানিয়া রাজ্যপালের হাতে সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা রাখিতেই হয়, তবে তাঁহার সিদ্ধান্ত হইতে সন্দেহজনক গন্ধটি যেন এমন তীব্র না হইয়া উঠে, তাহা নিশ্চিত করাও কর্তব্য।
সেই পথেও কাঁটা। বর্তমানে দেশের ১৮টি রাজ্যে রাজ্যপাল পদে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা আসীন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা নিযুক্ত হইলেই সেই ব্যক্তির আর স্বাধীন, নৈতিক অবস্থান গ্রহণের উপায় থাকে না, এমন দাবি করিবার প্রশ্ন নাই। কিন্তু, বারংবার যদি প্রমাণিত হয় যে পদের মাহাত্ম্য অপেক্ষা রাজনৈতিক আনুগত্যই গুরুত্ব পাইতেছে, তবে প্রশ্নটি উঠিবে। নিন্দুকের মতে, বিজেপি-নিযুক্ত রাজ্যপালদের অনেকেরই জীবনের চরমতম কৃতিত্ব সঙ্ঘের প্রচারক বা মন্ত্রী হইতে পারা। এবং, স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে রাজ্যপালের পদটিতে নিয়োগের জন্য সর্বজনমান্যতার যে অলিখিত শর্তটি ছিল, তাহা মানিলে ইহাদের অনেকেরই পদটি জুটিত না। ফলে, পদপ্রাপ্তির জন্য অনেকেরই কৃতজ্ঞতার বোঝা বিপুল, এবং সুযোগ পাইলে সেই ঋণ শোধ করিবার তাগিদ বিপুলতর। নৈতিকতা সেই তাগিদের সম্মুখে বালির বাঁধও নহে। গণতন্ত্রের এই ক্ষতিটিরও সূচনা ইন্দিরা গাঁধীর আমলে, সন্দেহ নাই। কিন্তু, তাহাকে অতিক্রম করিবার ইচ্ছা বা সাহস নরেন্দ্র মোদীর দৃশ্যত নাই। তিনি সন্তুষ্ট হইতে ব্যগ্র। তাঁহার অনুগতরা তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিতে ব্যগ্রতর। প্রসঙ্গত, বজুভাই বালা গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।