CAA

মানিয়ে নেওয়ার সংস্কৃতি কতদিন? অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে!

ঘটে যাচ্ছে বহু কিছু। কিন্তু আমরা চোখ বন্ধ করে মানিয়ে নিচ্ছি। রুখে দাঁড়াচ্ছে নবীন প্রজন্ম। কিন্তু নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ছাড়তে পারছি না। লিখছেন রুদ্র সান্যাল এ ভাবে দেখলে বেশির ভাগ পরিস্থিতিই মোটামুটি এড়িয়ে চলা সম্ভব। তা সে বিপদই হোক বা আপদ! আর এই ভাবনাটাই ভাল করে বুঝেছে শাসকযন্ত্র। সাধারণ মানুষের মনের এই সুবিধাবাদী নীতিকে দেখেই শাসক বুঝতে পারে, তারা কত দূর অবধি মানিয়ে নিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২০ ০৬:১৯
Share:

মানিয়ে নেওয়াই বোধ হয় এই সময়ের সব চেয়ে ভাল ব্যবস্থা। সব কিছুকে মানিয়ে নিতে নিতে এখন এমন একটা অবস্থায় আমরা পৌঁছে গিয়েছি, যখন কোথাও অন্যায়, অবিচার হতে দেখলে আমরা প্রতিবাদে রাস্তায় না নেমে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাটাই সবার আগে করি। সে দুর্নীতি দেখলেও, অন্যায় হতে দেখলেও! মানিয়ে চলার মধ্যেই যেন মেলে এক ধরনের আত্মতুষ্টি! বড়রা ছোটদের বলবে, মানিয়ে চলো। ছোটরাও বিশেষ পরিস্থিতিতে বড়দের বলবে মানিয়ে চলতে। আমরা শিখে গিয়েছি মানিয়ে চলতে!

Advertisement

কিন্তু প্রশ্নটা দাঁড়ায়, এ ভাবে আর কতদিন? আর কতদিন মানিয়ে চলতে হবে? অনেকের কাছে হয়তো মানিয়ে চলাই চলতি সময়ের পক্ষে সবচেয়ে ভাল পরিস্থিতি! তাতে কারও সঙ্গেই অশান্তিতে জড়াতে হয় না! এ ভাবে দেখলে বেশির ভাগ পরিস্থিতিই মোটামুটি এড়িয়ে চলা সম্ভব। তা সে বিপদই হোক বা আপদ! আর এই ভাবনাটাই ভাল করে বুঝেছে শাসকযন্ত্র। সাধারণ মানুষের মনের এই সুবিধাবাদী নীতিকে দেখেই শাসক বুঝতে পারে, তারা কত দূর অবধি মানিয়ে নিতে পারে।

পৃথিবী বদলায়, সমাজ পাল্টায়। তাও মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে যে নেতিবাচক মনোভাবই কাজ করে, তা বোধ হয় আমরা বুঝেও না-বোঝার ভান করি। কিন্তু সমাজের মধ্যে এক শ্রেণির মানুষও থাকেন, যাঁরা এই নেতিবাচক দিকের কুফল বুঝেই মানিয়ে নেওয়ার ‘সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। তাঁদেরই শাসক তথা সমাজপ্রভুরা দেশদ্রোহী বা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর বলে অভিহিত করে। রাজনীতির খেলায় মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া মানুষজনকেই আক্রমণের শিকার হতে হয় চিরকাল।

Advertisement

আমরা সারা পৃথিবীর যে কোনও মানিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকেই দু’হাত তুলে সমর্থন জানাই! অথচ, ঘরের পাশে অন্যায় ঘটলে, মানিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলে তাকে কতটা স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন করি, সে এক বিরাট প্রশ্ন! কেউ প্রতিবাদ করলেই তাঁকে আগে থেকে স্থির করা কিছু তকমা দিয়ে দেগে দিয়ে বিষয়টাকে সরলীকৃত করে তোলার চেষ্টা করি। আবার তার প্রতিক্রিয়ায় কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকেও আক্রমণ করতে দ্বিধা বোধ করি না। সমস্যার গভীরে না গিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আর যত সেই সিদ্ধান্তকে নিজেদের মনের মতো যুক্তিতে বাঁধতে যাই, ততই তা শাসকের সমর্থন পায়। মূল সমস্যাকে গৌণ করে অন্য সমস্যাকে মুখ্য করে তোলা হয় এই ভাবেই।
আমরা অনেক কিছুই মেনে নিয়েছি তো! সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রচার মেনে নিয়েছি! সংকীর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি! আসলে, এই মানিয়ে নেওয়াই এখন আমাদের ‘সংস্কৃতি’! কিন্তু মুশকিল হল, সবাই তো আমাদের মতো নয়! কেউ কেউ তো একটু অন্য ভাবেও ভাবতে পারেন! পৃথিবীর যে কোনও দেশেই প্রতিবাদ মূলত নবীন প্রজন্মই করে। ছাত্রসমাজই করে। তা সে তিয়েনআন মেন স্কোয়ারই হোক বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া কিংবা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়! প্রতিবাদ করবেই ছাত্রসমাজই এই মানিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে। তাই চিরকাল শাসকের চক্ষুশূল বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জীবিত ছাত্রছাত্রীরাই। সমস্যা বল, ছোট মাপের রাজনীতি নবীন প্রজন্মকে দিশা না দেখিয়ে নিজেদের ফয়দা তোলার জন্যই ব্যস্ত থাকে। এটাই গণতন্ত্রের করুণ বাস্তবতা।

কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? ১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে শাসকগোষ্ঠী পড়ুয়াদের, বুদ্ধিজীবীদের, শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের নির্মম ভাবে হত্যা করে। তারপরও আমাদের শিক্ষা হয়নি! শাসকের চরিত্র সব দেশে সর্বকালেই একই রকম। তা সে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত শাসক হোক বা সামরিক শাসক আমরা প্রতিবাদ সার্বিক ভাবে কখনওই করিনি। কারণ, মেনে নিতে শিখে গিয়েছি আর ভেবে নিয়েছি, যাই ঘটুক না কেন, আমাদের কিছু হবে না!

এক অন্য রকম ঝরা সময় এখন। সবসময় নিরাপত্তাহীনতা আর আতঙ্ক সর্বস্তরে সর্বক্ষেত্রে বয়ে চলেছে। প্রতিবাদে মুখর পথ। কিন্তু শাসকের কাছে কতটা সেই প্রতিবাদ পৌঁছতে পেরেছে, সেটা প্রশ্ন। পরিবর্তন কখনওই প্রবীণেরা একা আনতে পারেননি। সব সময়ই উদ্যম দেখিয়েছে যৌবনই। তা সে রাশিয়ায় বিপ্লবই হোক বা ব্যবস্থার পতন। ভারতে জরুরি অবস্থার সময়ও তরুণসমাজই রুখে দাঁড়িয়েছিল। তাই প্রতিবাদ তীব্র হয়েছিল।

এখনও প্রতিবাদ হচ্ছে আর তার বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীর তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাচ্ছে কুৎসিত প্রকাশভঙ্গিতে। যা শালীনতার সীমা অতিক্রম করছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। এটাই সবচেয়ে দুঃখের। আমরা মেনে নিচ্ছি আর অন্য প্রান্ত আরও উৎসাহিত হচ্ছে। কারণ, আমরা মেনে নিতে শিখে গিয়েছি। সর্বস্তরে যেভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া দরকার, তা হয়ে উঠছে না। বাংলা তথা ভারতের গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তীব্র ভাবে আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। এই শিক্ষাঙ্গনগুলি শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী। কিছু বিশিষ্টজনও পথে নেমেছেন। কিন্তু যাঁদের আমারা সবাই কৃষ্টিসংস্কৃতির ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্র বা খেলাধুলোর ক্ষেত্রে আদর্শ ভাবি, তাঁদের বেশির ভাগ অংশই কেমন যেন চুপচাপ! আসলে, ওই মানিয়ে নেয়ার অভ্যাস! আর আমরা অভ্যাসের দাস! সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যায়, যে কোনও সমস্যার ক্ষেত্রে দিশাহীনতাই এ দেশে প্রকট ভাবে দেখা দিচ্ছে। আর্থিক সমস্যার তীব্রতা অনুভূত হলেও তাকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মের আফিমের মোড়কে। দুঃখটা এটাই!

সেই কবে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘যত মত তত পথ’। কিন্তু ক’জন সেই আর্ষ মানলাম? শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি বাড়িতে রেখে পুজো করেই দায়িত্ব শেষ করলাম আমরা! তাঁর মতাদর্শকে গ্রহণ করলাম কোথায়! গ্রহণ করলাম না বলেই মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না! রাজনীতির খেলায়, মানিয়ে নেওয়ার খেলায় আজ অভ্যস্ত আমরা! যাই ঘটুক, চুপচাপ থাকো, মানিয়ে নাও! মানিয়ে নাও, সব কিছু মানিয়ে নাও! আর মৃত্যুমিছিলের পথে এগিয়ে যাক একদল পাগল ছেলেমেয়ে!

(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement