কাশ্মীরে পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে জঙ্গিদের আত্মঘাতী গাড়ি বোমা হামলায় মারা গিয়েছেন ৪৪ জন ভারতীয় জওয়ানের সঙ্গে নদিয়ার সুদীপ বিশ্বাস। এই ঘটনায় সমগ্র দেশ শোকস্তব্ধ, মর্মাহত, বাক্রুদ্ধ।
তেহট্টের হাঁসপুকুরিয়া গ্রামের বীর সন্তান সুদীপ বিশ্বাস। তাঁর জোৎস্নাস্নাত কফিনবদ্ধ ছিন্নভিন্ন দেহ দমদম বিমান বন্দর থেকে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক হয়ে রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে গ্রামের ইটপাড়া রাস্তা পেরিয়ে বিশ্বাসপাড়া বারোয়ারি মণ্ডপের সামনের মাঠে যখন এসে পৌঁছল, তখন চার দিকে শুধু কালো মাথার ভিড়। ‘জয় হিন্দ’, ‘ সুদীপ তুমি অমর রহে’ স্লোগানে হাঁসপুকুরিয়া সহ গোটা জেলার আকাশ-বাতাস আন্দোলিত।
চাঁদের আলো মাথায় করে ভাগীরথীর তীরে শ্মশানের পথ পাড়ি দিল শোকস্তব্ধ জনতার মিছিল। মায়ের পছন্দের জিলিপির ঠোঙা আজ সুদীপ আনেননি। মায়ের সামনে ছেলের কফিনবদ্ধ-প্রাণহীন দেহ। মায়ের বুকফাটা কান্নার আর্তনাদ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। প্রতিটি উপস্থিত মানুষের চোখে জল। এ জল সুদীপের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধার। ক্রীড়ামোদী সুদীপ কথা দিয়েছিলেন, পরের ছুটিতে গ্রামের বন্ধুদের জন্য কাশ্মীর থেকে উইলো কাঠের ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে আসবেন। বন্ধুদের জন্য ক্রিকেট ব্যাট আসেনি, পরিবর্তে এসেছে জাতীয় পতাকায় মোড়া কাঠের কফিন বাক্স। পলাশির রামনগর ভাগীরথীর ঘাটে পবিত্র আগুনের শিখায় প্রিয় সন্তানের অন্তিম পরিণতির নীরব সাক্ষী রইলেন জওয়ানের বাবা সন্ন্যাসী বিশ্বাস। কোনও বাবার জীবনে এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি আর কিছু নেই। সন্ন্যাসী প্রিয় সন্তানকে দেশের হোমযজ্ঞে আহুতি দিলেন। প্রাণের স্তব্ধতা বড় বেদনাদায়ক।
৬ ডিসেম্বর নদিয়ার করিমপুরের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বালিয়াশিশার গ্রামের প্রান্তিক চাষির ছেলে বিএসএফে কর্মরত ২৭ বছরের প্রসেনজিৎ বিশ্বাসের পাকিস্তানের সেনার অতির্কিত গুলিতে অকালে প্রাণ ঝড়ে গেল। বিধবার কোলে প্রসেনজিতের দুধের সন্তান। সন্তানের মুখে ‘বাবা’ ডাকও শুনতে পেলেন না প্রসেনজিৎ। নদিয়ার সীমান্ত এলাকা করিমপুরের অভয়পুর গ্রামের অতি দরিদ্র পরিবারের আর এক বীর সন্তান অরূপ কর্মকার প্রাণ দিলেন ছত্তীশগঢ়ে মাওবাদীদের গুলিতে।
জেলায় মায়ের কোল খালি হওয়ার এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রতিটা দিন।
এই জেলার আর্থ-সামাজিক পরিবেশের কারণে স্কুল পেরোনো ছেলেরা দল বেঁধে যায় বিএসএফ, সিআরপি, মিলিটারি লাইনে, ফৌজে চাকরির জন্য। পরিবেশ, পরিস্থিতি বাধ্য করছে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার যুবক-যুবতীদের এই ঝুঁকির চাকরি গ্রহণ করতে।
নদিয়া বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় সীমান্তরক্ষী জওয়ানদের কথাবার্তা, হাতে স্টেনগান, চাল-চলন, আদব কায়দা, খাঁকি জলপাই রঙের পোশাক এলাকার স্কুল-পড়ুয়াদের মনে এক রোম্যান্টিকতার সৃষ্টি করে। তারা আকৃষ্ট হয় এই পেশায়। সীমান্ত অঞ্চলের জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ প্রান্তিক চাষি অথবা দিনমজুর। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়—অবস্থা। দারিদ্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়। স্কুলের গণ্ডি পেরোলেই এই সব ঘরের যুবকের একটাই লক্ষ্য— ফোর্স লাইনে জয়েন করা। পড়াশোনার সঙ্গে চলে শারীরিক কসরত। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই তাঁরা কাকভোরে বেরিয়ে পড়ে দৌড় প্রাকটিস করতে। এ যেন ধনুক ভাঙা পণ— ফোর্সে চাকরি পেতেই হবে। বেশিরভাগ ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজের চৌহদ্দির পথে পা না বাড়িয়ে জীবনকে বাজি রেখে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়ে। তাঁরা লক্ষ্যে অবিচল, অনড়, অটল। এ লড়াই বাঁচার লড়াই, মায়ের অসুখের চিকিৎসার লড়াই, অক্লান্ত পরিশ্রম থেকে বাবাকে বিশ্রাম দেবার লড়াই, ভাইয়ের কলেজে পড়াশোনার টাকা জোগানোর লড়াই, বোনের সুপাত্রে বিয়ে দেওয়ার লড়াই, একটা ছোট্ট পাকা বাড়ি তৈরি করার লড়াই। ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে পরিণত করতে স্বজন-পরিজন ছেড়ে অরণ্য-পাহাড়-পর্বত-মরুভূমি প্রান্তরে অতন্দ্র প্রহরীরত দিবারাত্রি। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’র সমাজ-ইতিহাসের কাহিনী শোনার আর সময়-সুযোগ হল না, ঠিক ভাবে জানা হল না আসলে কাশ্মীর সমস্যা কী, জানা হল না কেন পাকিস্তান আমাদের চির-শত্রু, জানা হল না কেন কাশ্মীরে আতঙ্কবাদীরা ঘাঁটি গড়েছে।
কারণ, জওয়ানদের জানতে নেই, বুঝতে নেই। জওয়ানদের শুধু শেখানো হয় কী করে প্রতিপক্ষকে মারতে হয় ও দেশের জন্য মরতে হয়। আর সেই মারণখেলায় নবতম সংযোজন জঙ্গি হামলায় পুলওয়ামায় ৪৪ জন জওয়ানের ছিন্নভিন্ন দেহ।
স্বাধীনতার সাত দশক পরেও বাংলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে কর্মসংস্থানের জায়গা ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। নদিয়া কৃষিসমৃদ্ধ জেলা হওয়া সত্ত্বেও কৃষিভিত্তিক শিল্প তৈরি হয়নি এখনও। সীমান্তবর্তী গ্রামের বেকার যুবকেরা দিন গুজরানের জন্য বিপদসঙ্কুল জীবনের পথে পাড়ি দিতে বাধ্য হন। হয় পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে ভিন্ রাজ্য বা বিদেশে যান, না হয় ফৌজে যোগদান করে। সিভিল চাকরির বাজারে অসম লড়াইয়ে পিছনের সারিতে চাষি-দিনমজুর ঘরের যুবক-যুবতীদের একমাত্র ভরসা ফৌজ লাইন। তাই আদাজল খেয়ে নিজেকে তৈরি করেন। তার পর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে ফোর্স লাইনে বিপদসঙ্কুল জীবনে নিজেকে সঁপে দেন। যাঁরা সীমান্তে দিনরাত এক করে নিজের জীবনকে পণ রেখে দেশ সেবা করেন, তাঁরা খুবই সাধারণ খেটে খাওয়া ঘরের বাবা-মায়ের আদরের ধন। আর সেই আদরের ধনের কফিনবন্দি দেহ যখন অজ-পাড়াগাঁয়ে এসে পৌঁছয়, তার পর গোটা দেশ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের স্লোগান ওঠে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিশোধের আগুন নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুক ঠুকে লড়াইয়ের ময়দানে শামিল হতে বলেন, তখন সুদীপের পাশের গ্রামের আর এক জওয়ানের মায়ের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় ভয়ে— এই বুঝি যুদ্ধ বাধল, তার প্রাণের খোকাকে আর মনে হয় দেখতে পাবেন না।
দুই-তিন দশক আগেও বাপ ঠাকুরদার জাত-পেশা আকড়ে ধরে ভবিষ্যৎ জীবনের পথ চলা শুরু হত গ্রামের ছেলেদের। সময় বদলায়, জীবনবোধ বদলায়, স্বপ্নগুলোও বদলায়। দিনমজুর, চাষির ছেলে লাঙল ছেড়ে বন্দুক ধরে। নিজের গ্রাম ফাঁকা করে দেশ পাহারার মহান কাজে জোয়ান মরদেরা পাড়ি দেয়।
পুলওয়ামার ঘটনার পরে প্রতিশোধ স্পৃহায় মনুষ্যত্বের ছদ্মবেশে বর্বরতার নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশ চিন্তিত করে তুলেছে সুধী সমাজকে। দিকে দিকে পশুত্বের তাণ্ডব, শান্তির দীপশিখাটি ভয়ে কম্পমান। সুদীপের মৃত্যু আবার প্রশ্ন তুলেছে— কেন বারে বারে দিনমজুর, চাষার ছেলেদের প্রাণ বিসর্জন হবে? বাংলার আর এক জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা সাঁতরা গান্ধারির অন্ধপট্টি খুলে দিয়েছেন। কিন্তু পট্টি-খোলা চোখেও আজ আমরা অন্ধ।
শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক