নির্বাচন ঘোষণা পর ঢেকে দেওয়া হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি। —ফাইল চিত্র।
নিত্যদিন সকালে বেশ কিছু মুখ ভেসে আসে ‘হোয়াটসঅ্যাপ’-এ। কিছু দৈনন্দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে, কিছু স্রেফ উপস্থিতির জানান দিতে। ‘সোশ্যাল মিডিয়া’য় নিত্যদিন প্রতিদিনের ছবি-কাহিনির জোয়ার বহমান থাকে। তাতে ভাটা আসে না। অদূর ভবিষ্যতেও আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ মনে হয়। পৃথিবীর যে কোনও চিত্রশালার সংগ্রহকে যেন আমাদের ব্যক্তিগত মুখের আলোকচিত্রমালা ছাপিয়ে যাবে।
তার মধ্যে কিছু মুখ আমাদের সামনে মাঝেমধ্যেই ভেসে ওঠে। সে মুখ রাজনৈতিক। নির্বাচনের প্রস্তুতি এখন অনেক আগে থেকে করাটাই রীতি। শুরু হয়ে যায় নেতানেত্রীদের বড় বড় ‘কাটআউট’ ও ফেস্টুন লাগানো। মুখ দিয়ে মুখ ঢাকার ‘প্রতিযোগিতা’ও দেখা যায় কোথাও কোথাও। শহিদের জন্য নিবেদিত ফেস্টুনে সার বেঁধে ছাপা হয় হাস্যমুখের রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের মুখ। কখনও রাস্তার ধারের খাল, জমি ও দিগন্ত ঢাকা পড়ে। তার পরে ভোটের দিন ঘোষণা, মঞ্চের ভাষণ, হুঙ্কার, মারামারি, মৃত্যু, ভোটের ফল ও জয়োৎসব। এই সময়কালের মধ্যে ছবির পিছনের জগত অনেকখানি বদলে যায়। কোথাও নতুন ফসল ওঠে, কোথাও নতুন বাড়ি। কখনও জমির মালিকানা পাল্টায়, কখনও রাজনৈতিক আনুগত্য বদলে যায়।
ভোটের পরে ‘কাটআউট’ ও ফেস্টুনের মুখ সরে যায়। কিন্তু এখন কিছু মুখ সারা বছরই আমাদের সঙ্গে থেকে যায়। সে মুখ দেশ ও প্রদেশের পরিচালকদের। রাষ্ট্র পরিচালনায় সাফল্যের কিছু তথ্য ও সঙ্গে মুখচ্ছবি। আগে রাজ্যগুলির তথ্য দফতর ও কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক নিজস্ব শিল্পীদের দিয়ে কিছু ছবি করিয়ে নিত। চাষির ধান কাটা ও শ্রমিকের হাসিমুখ হাতুড়ি ধরার ছবি অনেকেরই স্মৃতিতে রয়েছে। নতুন ধারার ছবিতে শ্রমিক-কৃষকেরা প্রায় হারিয়ে গিয়েছেন। সেখানে রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক মুখ। পুরনো বলতে পরিবার পরিকল্পনার দুই শিশুর সঙ্গে দম্পতি এখনও রয়েছে। ডেঙ্গুর কারণে সনাতন মশাকেও মাঝেমধ্যে দেখা যায়। আগে কোনও মূর্তি বা স্মারক ভবনের উদ্বোধনে উদ্বোধকের নামই শুধু মর্মরে লেখা হত। এখন ছবি দেওয়ারও চল হয়েছে। সব কিছু মিলে একুশ শতকের সূচনা তথ্যপ্রযুক্তির যুগ হিসেবে হলেও কার্যত তা মুখ-প্রাচুর্যের যুগ বলে মনে হতে পারে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
অথচ, এই মুখকে আড়ালের কী সযত্ন প্রয়াস ছিল গত শতকেই! ১৯১৩-তে রবীন্দ্রনাথের নাম যুক্ত হল নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায়। সে পুরস্কারের মধ্য দিয়ে এই মহাদেশের আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস নতুন করে প্রতিষ্ঠা পেল। তাই উচ্ছ্বাস ছিল মহাদেশ জুড়ে। তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দিন তিনেক পরে উইলিয়াম রোটেনস্টাইনকে লেখেন যে, জনতার উত্তেজনার ঘূর্ণিবায়ুতে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কুকুরের লেজে টিন বেঁধে দিলে বেচারা কুকুর নড়লেই যেমন শব্দ হয় আর লোকের ভিড় জমে, তাঁর অবস্থা তেমনই বিভীষিকাময়। টিন বাজানো সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁর শুধু নিজের বাঁচা কর্ম ছিল না, আশ্রমের আবাসিকদেরও সরে থাকতে বলতেন।
নোবেল পুরস্কারের বছরে পৌষ উৎসবের ভাষণে রবীন্দ্রনাথ আশ্রমিকদের বললেন যে, বাইরের উত্তেজনায় মনকে চেতিয়ে তুললে শক্তির ক্ষয় হয়। গাছের ভিতরের রসে যখন বসন্তের নাড়া পায়, তখনই ফুল ফোটে, সেই ফুলই সত্য। যে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সযত্নে আড়াল করেন, তিনিই আবার প্রার্থনা করেন, ‘হে রুদ্র, তোমার যে প্রসন্নসুন্দর মুখ, তোমার যে প্রেমের মুখ, তাই আমাকে দেখাও’। সে মুখেই রবীন্দ্রনাথ অনন্তকালের পরিত্রাণ খোঁজেন। কিন্তু এ কি একান্তই ধর্মের গীত যার সঙ্গে রাজধর্মের যোগ নেই! অথচ, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক বোধ যে কী প্রখর ছিল তা, ‘ন্যাশনলিজম’ বা ‘সভ্যতার সঙ্কট’ পড়লেই বোঝা যায়।
আমাদের ব্যক্তি কিংবা সামাজিক জীবন বিশ বছর আগেও এত মুখ-মুখর ছিল না। অন্নপ্রাশন বা বিয়ের ছবি তোলা হত ঠিকই, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে মৃতের ছবি তোলা বেশ কঠিন ছিল। কারও মৃত্যু হলে তাঁর শেষ স্মৃতিটুকু ধরে রাখার জন্য আলোকচিত্রী খুঁজে পাওয়া যেত না। দেখা যেত, হয় তিনি আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছেন, নয়তো ক্যামেরার ‘রিল’ ফুরিয়েছে। স্মৃতি রক্ষার সহজ উপায় ছিল মৃতের পায়ের তলায় আলতা মাখিয়ে কাগজে ছাপ নিয়ে রাখা। তা বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙানোও হত।
মুখের মাহাত্ম্য বলতে গিয়ে অতীন বন্দোপাধ্যায়ের কাছে শোনা একটি ঘটনা মনে পড়ে যায়। ছোটবেলায় এক বার তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান স্বভাব এবং কিছুটা অভাবেরও কারণে। বিনা টিকিটে সে দিনের ইলাহাবাদ পর্যন্ত যান। কিন্তু মায়ের গয়না বিক্রির যে পঁচিশ টাকা তাতে বেশিদিন চলেনি। ফেরার পথে বর্ধমানে ট্রেন থেকে নেমে যান ধানের জেলায় ভাতের অভাব হবে না ভেবে। রাতে শুয়েছিলেন একটি গাড়িবারান্দার নীচে। পরের দিন এক মুসলমান মিস্ত্রি ছেলেটির ক্ষুধার্ত মুখ ও বিবর্ণ পোশাক দেখে স্নান ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আশ্রয়ও মিলে যায় গাড়িশালে। সেই আশ্রয়দাতার মুখ তিনি কোনও দিন ভোলেননি। আর তাই দেশভাগের শিকার ও দাঙ্গার সাক্ষী হলেও সাম্প্রদায়িকতার কোনও জায়গা নেই তাঁর লেখায়।
আমার বিশ্বাস, দেশের মুখ চিনতে দশের মুখই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। গ্রামের রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যায়, তখন বোঝা যায়—কোথাও একটা পরিবর্তন এসেছে। টোটোর চালক যখন গাড়ি চালাতে চালাতে গানের সুর ভাঁজেন, তখন আঁচ করা যায় যে, রাস্তার হাল ফিরেছে। হাসপাতালে রোগীর বাড়ির লোকজনের হাসিমুখ দেখলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে চিকিৎসা ভালই হচ্ছে। আবার রোগীর তুলনায় আয়াটিকে যখন রক্তহীন দেখি, তখন কার উন্নয়নের চাল কে খায় সে প্রশ্ন জাগে।
রাষ্ট্রের আদর্শ রূপ কী, তা জানা নেই, কিন্তু গণতন্ত্রের মুখ বলতে এঁদেরই বুঝি।
লেখক বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগের প্রাক্তন ডিরেক্টর