জাতীয় নিরাপত্তা আইন লইয়া একটি অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্ন বার বার উঠিতেছে। এই দেশের আইনবিভাগের তাহা প্রণিধানসহকারে শোনা দরকার। প্রশ্নটি হইল: ঔপনিবেশিক আমলের এই দমনমূলক প্রাক্-আধুনিক আইনটি কি সত্যই জরুরি? আর যদি জরুরি হয়ও, কী ভাবে, কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করিলে তাহা জাতিকে সত্য অর্থে সুরক্ষিত করে? প্রশ্নগুলি উঠিতেছে কেননা সঠিক বিবেচনা ব্যতিরেকে এই আইনের প্রয়োগ জাতিকে সুরক্ষা তো দেয়ই না, বরং প্রবল ভাবে অরক্ষিত ও অনিরাপদ করিয়া দেয়। সম্প্রতি চিকিৎসক কাফিল খানের বিরুদ্ধে যে ভাবে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের (এনএসএ) ধারা প্রয়োগ করিল উত্তরপ্রদেশ সরকার, তাহাতে আর এক বার বিপদসঙ্কেত বাজিয়া উঠিল। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করিয়াছিলেন কাফিল খান। সেই বক্তব্যকে ‘বিদ্বেষ বার্তা’ আখ্যা দিয়া তাঁহাকে ডিসেম্বরের শেষে গ্রেফতার করা হয়। আদালত তাঁহাকে জামিন দিবার পরেও কাফিলকে ছাড়া হয় নাই, তড়িঘড়ি এনএসএ-র ধারা প্রয়োগ করা হইয়াছে। এনএসএ দ্বারা রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক ব্যক্তিকে রাষ্ট্র বিনা প্রশ্নে গ্রেফতার করিতে পারে, তাই এই মৌলিক প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য যে দলহীন, একক, পূর্ব অভিযোগের ইতিহাস-বিহীন এক নাগরিক কী ভাবে একটি রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার জন্য এত বড় ‘ঝুঁকি’ হইয়া দাঁড়াইলেন? সন্দেহ হয়তো ভিত্তিহীন নয় যে, সরকার-বিরোধী বলিয়া পরিচিত এই চিকিৎসককে মুক্তি দিতে অনিচ্ছার জন্যই এনএসএ-র মতো কঠোর আইনের প্রয়োগ করিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। ইউএপিএ, এনএসএ, কাশ্মীরের জনসুরক্ষা আইন (পিএসএ), রাষ্ট্রদ্রোহিতা প্রভৃতি আইনগুলি সন্ত্রাসবাদীকে রুখিবার উদ্দেশ্যে যে প্রবল ক্ষমতা পুলিশ-প্রশাসনের হাতে তুলিয়া দিয়াছে, তাহাতে নাগরিকের অধিকার নস্যাৎ করিয়া তাহাকে বন্দি করা অতি সহজ। বিরুদ্ধ কণ্ঠ স্তব্ধ করিতে, বিরোধীকে ‘শিক্ষা’ দিতে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার যে কোনও সময়ে এই আইনের অপপ্রয়োগ করিতে পারে।
এবং করিতেছে। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় আসিবার পর এক বৎসরে একশত ষাট জন মুসলিম এনএসএ-তে গ্রেফতার হইয়াছেন। কাশ্মীরে গত বৎসর ছয় শতেরও অধিক নাগরিক পিএসএ-তে গ্রেফতার হইয়াছেন, তাহার অধিকাংশই ৩৭০ ধারা বাতিল হইবার পরে। কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা হইতে মণিপুরের সাংবাদিক কিশোর চন্দ্র ওয়াংখেম, দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ হইতে অসমের কৃষক নেতা অখিল গগৈ, সরকারের অস্বস্তি যিনিই বাড়াইয়াছেন তাঁহাকেই যেন দেশের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ মনে হইয়াছে রাজ্য বা কেন্দ্রের। বার বার অভিযোগ উঠিয়াছে, আদালতে ইহাদের ‘দুষ্কর্মের’ প্রমাণ দিবার দায় এড়াইতে, বিনা বিচারে বন্দি রাখিতেই সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ধারা প্রয়োগ করিতেছে সরকার। এই ধরনের আইনগুলিতে ‘উকিল-আপিল-দলিল’ কিছুই গ্রাহ্য নহে। অতএব বন্দিদের দশা অনুমেয়।
ঠিকই যে এই আইন নূতন নহে। এই ধরনের আইন লইয়া উদ্বেগও নূতন নহে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গাঁধীর সময়েও এই উদ্বেগ দেখা গিয়াছে। এনএসএ-র পুরাতন অবতারসমূহ (যেমন প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট, কিংবা মিসা) লইয়া তাই অতীতেও বার বার প্রতিবাদ ধ্বনিত হইয়াছে। তবে কিনা, উপরের উদাহরণগুলি বলিয়া দিবে, সম্প্রতি যে ভাবে প্রাত্যহিক ভিত্তিতে মুড়ি-মিছরির ন্যায় এই আইনের ব্যবহার হইতেছে, তাহা অভূতপূর্ব। এবং অতীব বিপজ্জনক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুরক্ষার নামে গণতন্ত্র-বিরোধী আইন চূড়ান্ত অসঙ্গত। নাগরিকত্বের এমন অবমাননা দিয়া গণতন্ত্রকে দুর্বল করার একমাত্র কারণ, বর্তমান সরকারের অসহিষ্ণু রাজনীতি। সরকার নিজের বিপন্নতা ঢাকিতে সমাজের নিরাপত্তা ধ্বংস করিতেছে।