West Bengal Lockdown

ব্যাগ হাতে রাস্তায় মানুষ, লকডাউন আর মানছে কই?

আসলে পুলিশের সঙ্গে রাস্তায় বেরনো মানুষের যেন চোর-পুলিশ খেলা চলছে সারা দিন। পুলিশ ধরলেই পকেট থেকে বের করে কেউ দেখাচ্ছেন প্রেসক্রিপশন, কেউ বা ব্যাঙ্কের বই। দ্বিতীয় দফার লকডাউন কেমন চলছে? অপ্রয়োজনে রাস্তায় বেরনো এক এক মানুষের এক এক রকম অজুহাত।

Advertisement

সুদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২০ ২০:৫৮
Share:

এই তো সে দিন লকডাউনের মধ্যে এক হাতে বাজারের ব্যাগ, অন্য হাতে বাচ্চার হাত শক্ত করে ধরে কৃষ্ণনগরের পাত্র বাজার থেকে বেরিয়ে আসছিলেন এক মহিলা। তাঁকে প্রশ্ন করা গেল— এই সময়ে বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে আসার কী দরকার পড়ল?

Advertisement

প্রশ্নের উত্তরে মহিলার জবাব, ‘‘কী করব? কিছুতেই শুনছে না। বলল, আমিও যাব।’’ তার পর মৃদু ধমকের সুরে বাচ্চাকে বললেন, ‘‘শুনলে তো? এর পর বেরলে কাকু কিন্তু খুব বকবে!’’ তার পর আবার বাচ্চার হাত ধরে মৃদুমন্দ গতিতে বড় রাস্তায় উঠে মিলিয়ে গেল মা ও শিশু।

কিন্তু রেখে গেল বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। তবে যে টিভি খুললেই বারবার শোনা যাচ্ছে— ‘‘লকডাউনকে হাল্কা ভাবে নেবেন না, ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন।’’ মোবাইলে কাউকে কল করলেও শোনা যাচ্ছে, ‘‘করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য ঘরে থাকাই একমাত্র রাস্তা।’’ সে সব কথা কি তা হলে মানুষের কানেই ঢুকছে না?

Advertisement

সত্যি তো, সকাল থেকে বিভিন্ন বাজারে মানুষের ভিড় দেখলেই বোঝাই যাবে না শহরে লকডাউন চলছে! শহরের দিকে পুলিশের ভয়ে চায়ের দোকানগুলো যদিও-বা বন্ধ থাকছে, গ্রামের দিকে তো বেশির ভাগই খোলা। সেখানে রীতিমতো জটলা, ভাইরাসের আদি-অনন্ত নিয়ে জমাটি আলোচনা চলছে। সেখানকার জটলার যুক্তি— ‘‘রোগটা তো ছোঁয়াচে। আমরা তো কেউ এলাকার বাইরে যাচ্ছি না। আমাদের কিচ্ছু হবে না।’’

অপ্রয়োজনে রাস্তায় বেরনো এক এক মানুষের এক এক রকম অজুহাত। কেউ বলেন, বাড়িতে মন বসছে না। কেউ বলছেন, এই তো পেয়ারা বা আঙুর কিনতে বেরিয়েছি। যাঁরা ওষুধের প্রেসক্রিপশন বাইরে বেরনোর ছাড়পত্র বানিয়েছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সেই প্রেসক্রিপশন বেশ কয়েক বছরের পুরনো— জানালেন, কর্তব্যরত এক পুলিশকর্মী।

আসলে পুলিশের সঙ্গে রাস্তায় বেরনো মানুষের যেন চোর পুলিশ খেলা চলছে সারা দিন। পুলিশ ধরলেই পকেট থেকে বের করে কেউ দেখাচ্ছেন প্রেসক্রিপশন, কেউ বা ব্যাঙ্কের বই। প্রশ্ন করে সদুত্তর না মিললে এক এক সময়ে বাইক বা সাইকেলের হাওয়া ছেড়ে দিচ্ছেন পুলিশ। কখনও বা কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছেন। তাতে অবশ্য হাওয়া খেতে বেরনো জনতার কিছু এসে যায় না। এই সুযোগে বন্ধ হয়ে থাকা টায়ার সারানোর অনেক দোকান খুলে গিয়েছে। পুলিশ চাকার হাওয়া ছাড়ছে, তারা গিয়ে ফের চাকায় হাওয়া ভরছে। পুলিশের গাড়ি আসছে শুনেই পাড়ার মোড়ের জটলাটা এ দিক ও দিক ছিটিয়ে যাচ্ছে। তার পর গাড়ি চলে গেলেই আবার সবাই এসে মিলছেন এক জায়গায়।

সন্ধ্যা হলেই বিভিন্ন পাড়ার গলিগুলোয় মাঝবয়সীদের জটলা। সাতসকালে দল বেঁধে প্রাতঃভ্রমণ। বিকেলে খেলার মাঠে বয়স্কদের আড্ডা। যাঁরা রাস্তায় মাস্ক পরছেন, তাঁদের অনেকেই ঠিকমতো করে মাস্ক পরছেন না। কারও মাস্ক নাকের নীচে, কারও কপালে, আবার কারও মাস্ক থুতনির নীচে দায়সারা করে বাঁধা। সব জায়গায় একটা চরম উদাসীনতার ছাপ। অযত্ন করে নিয়মরক্ষার চেষ্টা। কেউ কেউ আবার ত্রাণবিলির নাম করে রাস্তায় বেরনো, কোনও ত্রাণদানকারী দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছেন। দল বেঁধে দুর্গাপুজোর চাঁদা নেওয়ার মতো ত্রাণের চাঁদা সংগ্রহে বেরিয়েছেন কোনও কোনও এলাকার যুবকেরা।

ভাতজাংলার এক চিকিৎসক জানালেন, ‘‘লোক ডাকছে শুনে গেট খুলে দেখি পাড়ার ছেলেরা ত্রাণের চাঁদা নিতে এসেছেন। তাঁদের না আছে মাস্ক, না মানছে পারস্পরিক দূরত্ব।’’ আসলে সবই চলছে, তবে একটু সতর্ক ভাবে।

সতর্কতা নিজের স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য নয়, শুধুমাত্র পুলিশের ধমকের থেকে বাঁচতে। রাস্তায় বেরনো বেশিরভাগ মানুষেরই ভয়টা কিন্তু করোনাকে নয়। তাঁদের ভয়— পাছে পুলিশ এসে কিছু বলে! এ ভাবেই চলছে লকডাউন।

আর লকডাউনকে বাস্তবায়নের জন্য যাঁরা দিনরাত যুদ্ধ করে চলেছেন, করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন— সেই সব পুলিশকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মীরা সাধারণ মানুষের এই আচরণে হতাশ হয়ে পড়ছেন ধীরে ধীরে। দেশে করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে একাধিক চিকিৎসাকর্মী, পুলিশকর্মী আক্রান্ত। এমনকি, করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসক, পুলিশকর্মীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তার পরেও তাঁরা মাঠে নেমে লড়াই করছেন রাত দিন।

বিরক্ত হয়ে এক পুলিশকর্মী বলেই ফেললেন, ‘‘আচ্ছা পুলিশের কী দায় বলুন তো, এ ভাবে ঢাল-তলোয়ার ছাড়া মানুষের পিছনে ছুটে বেড়ানোর! এত করে বলছি, তবু শুনছেই না।’’

আরেক জন চিকিৎসকের কথায়, ‘‘কাদের জন্য জীবন হাতে করে লড়ছি ভেবে বড় হতাশ লাগছে!’’

এই সবকিছু সারাদিন দেখি আর ছবি তুিল। পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করছেন দেশের সব প্রান্তের সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। তবে প্রাণের মায়া তাঁদেরও আছে। তাই যখন অকারণে কাউকে রাস্তায় দেখি, খারাপই লাগে। শেষে এইটুকুই বলার— ঘাতক যেখানে অদৃশ্য, প্রতিষেধক এখনও অধরা, সেখানে গোষ্ঠীবদ্ধ সংক্রমণ ঘটলে তার ফল কতটা মারাত্মক হতে পারে, সে সম্পর্কে যদি এখনও ধারণা করতে না পারেন, তা হলে প্রশাসনের কথাটা অন্তত শুনুন। বোঝার চেষ্টা করুন, সংক্রমণ হলে আপনি খারাপ থাকবেন, ভুগবে আপনার নিজের পরিবার।

শুধু মাত্র আইন করে, নজরদারি চালিয়ে মানুষকে ঘরে রাখা সম্ভব নয়, যত ক্ষণ না তারা নিজেরা এই রোগের ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছে।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement