শহিদ মিনার। ফাইল চিত্র
আরও একটা মাতৃভাষা দিবস অতিক্রান্ত হল। দিনভর ফোনে, এসএমএসে, হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে অনেক শুভেচ্ছা পেলাম আমরা। শুভেচ্ছা দিলামও। কেউ বললাম, এ ভাষা মোদের গরব, মোদের আশা। কেউ প্রশ্ন তুললাম, সারা বছর নিজের ভাষাকে আমরা ঠিকঠাক গুরুত্ব দিই তো আদৌ? কেউ অনুযোগ করলাম, ইংরেজি-হিন্দির মতো ভাষাগুলো শেখার তাড়নায় নিজের ভাষাকে আজ অবহেলা করছে বাঙালি। কেউ আবার সদর্পে বললাম, বাঙালি নিজের ভাষার জন্য গর্ববোধ করতে জানে।
যা কিছু বললাম-করলাম-দেখলাম-শুনলাম, সেই পুরোটাই আসলে ভাষা দিবসের উপলব্ধি, পুরোটাই বাস্তব। অর্থাৎ নিজের ভাষাকে নিয়ে বাঙালির গর্ব অশেষ। কিন্তু, পরিস্থিতির চাপে নিজের ভাষার সর্বাত্মক চর্চায় বাঙালি আজ খানিকটা অপারগ। তার জন্য ভিতরে ভিতরে হা-হুতাশ রয়েছে। কিন্তু নিজের ভাষা নিয়ে গর্বও রয়েছে বিস্তর।
প্রতিযোগিতা আর পেশাদারিত্বের তাড়নায় নিজের ভাষার প্রতি কিছুটা অবহেলা বাঙালির রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই। যেখানে সুযোগ রয়েছে, সেখানেই নিজের বাড়ির ছেলেটাকে বা মেয়েটাকে বাংলা মাধ্যমের বদলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করানোর প্রবণতা রয়েছে। হিন্দি শেখানোর জন্যও বিস্তর তত্পরতা রয়েছে। কিন্তু মাতৃভাষাটা নিয়ে অতটা মাথাব্যাথা নেই।
এর উল্টোটাও কিন্তু সত্যি। বাঙালির জনসংখ্যার একটা তাত্পর্যপূর্ণ অংশের মধ্যেই যেমন স্কুলে-কলেজে বাংলাকে এড়িয়ে যাওয়ার বা অবহেলা করার প্রবণতা, তেমনই জনসংখ্যার একটা অত্যন্ত প্রভাবশালী অংশ কিন্তু বছরভর বাংলা নিয়েই ব্যস্ত। বাংলা ভাষায় আজও বিস্তর লেখালিখি হচ্ছে, অশেষ কথকতা চলছে, আজও এমন বাংলা বইয়ের নাম শোনা যাচ্ছে, যা কলকাতা বইমেলা থেকেই নিঃশেষে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
তা হলে বাংলা ভাষার অবস্থাটা ঠিক কী রকম দাঁড়াল? বাংলা ভাষা মৃতপ্রায় বা বাংলা ভাষা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, এমন কথা তো বলা যাবে না। শুধু দুই বাংলায় নয়, বিশ্বজুড়েই বাঙালির মধ্যে বাংলার চর্চা উল্লেখযোগ্য। তা হলে আমাদের ভাষার সঙ্কটটা ঠিক কোনখানে? সঙ্কটটা নিহিত রয়েছে পুরোদস্তুর ‘কাজের ভাষা’ হয়ে উঠতে না পারার মধ্যে। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির চর্চায় বাঙালির কাছে আজও বাংলাই মূল ভাষা। সাহিত্য চর্চার বাংলা আজও প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে সমৃদ্ধ হচ্ছে, শব্দকোষ রোজ পরিমার্জিত হচ্ছে আপন ছন্দে। সাহিত্য-সংস্কৃতি বা শিল্প চর্চার বাইরে যে বৃহত্তর পেশার জগত্, সেখানে বাংলা ভাষাকে খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছি না আমরা। কারণ বাংলাকে আমরা তার উপযুক্ত করে তুলতেই পারিনি এখনও পর্যন্ত।
বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা ভাষা তথা শব্দকোষ তার মূল অবয়ব পেয়েছিল। জগদীশচন্দ্র বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীদের লেখনি বাংলা ভাষাকে সেই সব সরণিতে হাঁটতে শিখিয়েছিল, যেখানে নিয়মিত হাঁটাচলার অভ্যাস থাকলে একটা ভাষা পুরোদস্তুর ‘কাজের ভাষা’ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা বহাল থাকেনি। বাংলাকে শিক্ষা ও পেশার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য করে তোলার প্রয়াসকে আর কেউ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। ফলে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, দর্শন বা ইতিহাসের চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে বাংলার কার্যকারিতা। কেউ বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চান, কেউ চিকিত্সাবিদ্যায় গবেষণা করতে চান, কেউ কারিগরি বা প্রযুক্তির দিকে যেতে চান, কেউ আইনজ্ঞ হতে চান, কেউ অন্য কোনও বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিতে চান। এঁদের কারও পক্ষেই কি বাংলায় পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? বাংলা ভাষায় সব ধরনের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ কি আমরা এথনও তৈরি করতে পেরেছি? পারিনি।
আরও পড়ুন: আমায় নিও সঙ্গে, বলল মাতৃভাষা
আরও পড়ুন: আমার বুকের মধ্যে সেই গরবিনী বাংলার উত্তরাধিকার
অন্য অনেক ভাষাতেই কিন্তু সে সুযোগ তৈরি হয়েছে। চিনে, জাপানে, রাশিয়ায়, ফ্রান্সে, জার্মানিতে মাতৃভাষার এই সঙ্কট কিন্তু নেই। কারণ নিজেদের মাতৃভাষাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাষা করে তুলতে পেরেছেন তাঁরা। চিনা বা জাপানি ভাষায় বিজ্ঞানের অত্যন্ত গূঢ় গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। রাশিয়ায় বা ফ্রান্সে কোনও পড়ুয়া নিজের মাতৃভাষায় স্বচ্ছন্দে ম্যানেজমেন্ট বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারছেন। কারণ ভাষাগুলো সে সবের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। বাঙালি নিজের মাতৃভাষাকে নিয়ে ওই পথে অগ্রসর হতে পারেনি।
অতএব, হা-হুতাশে লাভ নেই। বাঙালির ছেলেমেয়ে কেন বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ছে না, বাঙালি কেন বাংলা শেখার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দি শেখায় বেশি জোর দিচ্ছে— এ সব প্রশ্ন তুলেও লাভ নেই। বাস্তবটাকে উপলব্ধি করার সময় হয়েছে। বাস্তব হলে এই যে নিজের মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালির গর্ব কোনও অংশেই কমেনি। বাঙালি যে ভাষাতেই পড়াশোনা করুক, যে ভাষাতেই পেশাদারিত্ব অর্জন করুক, বাংলাই বাঙালির হৃদয়ের ভাষা আজও। মাতৃভাষা দিবসের মতো দিনগুলো বার বার প্রমাণ করে দিয়ে যায় সে কথা। কিন্তু বাঙালির জীবনে যদি বাংলাকে আরও বেশি করে চাই আমরা, তা হলে বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে হবে। আজকের পরিস্থিতিতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বা পেশার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়। কারণ উপযুক্ত পরিভাষা কাঠামোই গড়ে তোলা হয়ে ওঠেনি। সেই খামতি পূরণ করার দিকে পা ফেলব আমরা— ভাষা দিবস কাটিয়ে এসে যদি এমন কোনও শপথ নিয়ে অগ্রসর হতে পারি, তা হলে পরবর্তী ভাষা দিবসটা অন্য রকম হবে। না হলে একের পর এক ভাষা দিবস হা-হুতাশেই কাটবে।