ব্যর্থ: সিঙ্গুরে টাটা মোটর্স-এর কারখানা বন্ধ হওয়ার পর, ২১ মে ২০১১
প শ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি দু’টি খুব দরকারি কথা জানিয়েছেন। এক, ছোট ও মাঝারি শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ সফল এবং দুই, সারা রাজ্যে ছ’টি জায়গায় শিল্প সহায়ক কেন্দ্র তৈরি হবে। উত্তরবঙ্গেও একটি। আর একটি সিদ্ধান্তও উৎসাহ তৈরি করতে পারে। সপ্তাহে এক দিন অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং শিল্প-বিষয়ক অতিরিক্ত মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় গিয়ে প্রশাসনিক বাধাগুলির সুরাহা করবেন। স্থানীয় ছোট শিল্পপতিরা অনেক সময়ই নিয়ম-বহির্ভূত সুযোগ নিয়ে তার দায় স্থানীয় অফিসারদের ওপর চাপান। সেগুলোই খবর হয়। এই সমস্যাগুলোরও নিরসন হবে— মন্ত্রী ও সচিবের উপস্থিতির ফলে।
পরে এক চেম্বারের বক্তৃতায় অর্থ ও শ্রমমন্ত্রী জানিয়েছেন— ব্যাঙ্ক থেকে বড় শিল্প বাবদ ধার নিয়ে টাকা শোধ হয়নি ২০১৪-র আগে পর্যন্ত ২.৪ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে মাত্র চার বছরে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০.২৫ লক্ষ কোটি টাকা।
জানি না এই ঋণখেলাপি বা ব্যাঙ্কিং শিল্পের পরিভাষায় ‘অনুৎপাদক শিল্প’-র হিসেবের মধ্যে বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, তাঁর ভাই ও মামা ও আত্মীয়স্বজনের ব্যাঙ্কলুটের খবর ধরা আছে কি না। তাঁরা এখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলিতে খোঁজাখুঁজি করছেন, যেখানে ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানত রাখলেই ‘নাগরিকতা’ পাওয়া যায়: এমনটাই খবর।
চেম্বারের ওই বক্তৃতায় অমিত মিত্র এটাও জানিয়েছেন ছোট ও মাঝারি শিল্প ঋণ নেওয়া ও শোধ করায় রাজ্য দেশের মাথায়। ২০১১-১২’তে এই তহবিলে ৮৩৮৭ কোটি টাকা ব্যাঙ্কঋণ, ২০১৭-১৮ সালে তা এখনও পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৪৪০৫৯ কোটি টাকা।
এই পর্যন্ত জেনেই আমি আমার কথাটিতে পৌঁছেছি। আমি অর্থনীতিতে অন্ধের অধিক। যাঁরা তৃতীয় নয়নের অধিকারী তাঁরা একটু বুঝিয়ে বললে বুঝতে পারি কতটা ভুল বললাম। সে দিনই এমন এক বিশেষজ্ঞের মত কাগজে পড়লাম, একশো দিনের কাজের জন্য নাকি কৃষিপণ্যের দর বাড়ছে। যেন তাঁর দেখা সেই তাত্ত্বিক গ্রামে কৃষিশ্রমিকদের নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে— কেউ খেতের দিকে টানছে, কেউ একশো দিনের দিকে টানছে।
ছোট শিল্প, মাঝারি শিল্প, বড় শিল্প, স্বনির্ভর শিল্প— এগুলো তো সরকারি সাহায্য ও সমর্থন পাওয়ার এক-একটা ভাগ। শ্রমিকের সংখ্যা, উৎপাদনের পরিমাণ— এই সব দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এর বাইরে একটা বড় শ্রমিক সম্প্রদায় আছে। যেটা স্বাবলম্বী, সাহায্যহীন, নিজেদের দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। মারুতি গাড়ি বাজারে আসার আগে কলকাতা ছেয়ে ছিল এই পথের ধারের গ্যারাজে। সরকারি বা আধা-সরকারি জমিতে এই সব গ্যারাজে ইঞ্জিনের কাজ, ব্যাটারির কাজ, রঙের কাজ, বডির কাজ নিপুণ দক্ষতায় করা হত। মানিকতলার রাস্তার পুব দিকে, দমদম রোডে, মল্লিক বাজারে, রাইফেল রেঞ্জ রোডে, তারাতলা মোড়ের ডান দিকের রাস্তায়, এখনকার বিড়লা হাসপাতালের পিছনে ডায়মন্ড হারবার রোডের দু’দিকে। যাদবপুরের দিকে একটু কম ছিল, কিন্তু ভিতর দিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোডে, সল্টলেকে, একই সঙ্গে গড়িয়ার দিকে ও টালিগঞ্জের দিকে অনেক। কোথাও, কলকাতার কোথাও, গাড়ির ব্রেকডাউন নিয়ে বিপদে পড়তে হত না। এঁদের ভিতর এমনই ছিল বোঝাপড়া ও সততা যে কোনও একটি বিশেষ কাজের জন্য দূরের কারও কাছেও পাঠিয়ে দিতেন।
মারুতি বাজারে নেমে কিছু দিনের মধ্যেই নিজেদের অথরাইজ়ড গ্যারাজ বসাল, নিজেদের অথরাইজ়ড ইনশিয়োরার নিয়োগ করল।
তখন আমরা কেউ ভাবলাম না— এই অন্তত লাখখানেক স্বশিক্ষিত, গ্যারাজ মিস্ত্রিদের কী হবে। কী হল? যাতায়াতের সময় হঠাৎ চোখে পড়ে যায় ফ্লাইওভারের নীচে কিছু কিছু গ্যারাজ টুকটাক চলে। এক দিন সন্ধের পর দমদম রোড দিয়ে যেতে যেতে বোঝা গেল চাকার হাওয়া বিপজ্জনক রকম কম। দমদম রোডে সেই হাওয়ার জায়গা খুঁজতে হয়রান।
যে সব বিদেশি কোম্পানির গাড়ি বাজার ছেয়ে ফেলেছে, তাদের নিজস্ব গ্যারাজে তারা কোনও টুকরো পার্ট বদলায় না। তাদের নীতিই হচ্ছে— একটা গাড়ি পাঁচ বছর। আর, পুরনো রাস্তার ধারের গ্যারাজের নীতি ছিল— একটা গাড়ি এক জন্ম।
কোনও একটা দক্ষ শ্রমিক শ্রেণিকে নিঃশেষে উৎখাত করে কোনও বিকল্প ব্যবস্থা কায়েম করলে সেটাকে উন্নয়ন বলে না। এখন গ্রামের দিকে বা জেলার ছোট শহরে বা গঞ্জে বা বন্দরে— মোটর সাইকেল, তিন চাকার মালবাহী স্কুটার, ছোট ছোট ট্রাক, জলের পাম্প, টিভি ইত্যাদি সারানোর কাজ নিত্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে ও পড়ছে। ফলে ওই সব এলাকায় স্বশিক্ষিত দক্ষ কর্মী নিজে থেকেই তৈরি হয়ে উঠেছে। গরুর গাড়ি প্রায় উঠেই গিয়েছে।
এই দক্ষ শ্রমিকদের বা দক্ষতা অর্জনে সক্ষম শ্রমিকদের কি এই ছোট শিল্প-মাঝারি শিল্পের ভাগের বাইরে একটা কোনও ভাগে ফেলা যায় না? তা হলে হয়তো তিনি নিজের কাজের সহায়তা বা পরিপূরকতা হয় এমন একটা সম্প্রসারণ ঘটাতে পারেন। তাঁর বাড়ির সংলগ্ন এক টুকরো জমি হয়তো আছে। সামান্য টাকা পেলেই তিনি হয়তো একটা রোড সাইড গ্যারাজ তৈরি করে তুলতে পারবেন।
কিন্তু অমিতবাবু ও আলাপনবাবু সাপ্তাহিক জেলা সহায়ক কেন্দ্রগুলোর সফরে তো এঁদের দেখাই পাবেন না। তাঁদের কাজ তো জেলা বা মহকুমার শিল্প-আধিকারিকদের সঙ্গেই করতে হবে।
যাঁদের কথা বলছি, তাঁদের নিয়ে কাজটা সব চেয়ে ভাল হবে পঞ্চায়েত স্তরে। সেই পঞ্চায়েত এলাকায় এই ধরনের স্বশিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর যন্ত্র কারিগর কে কে কাজ করেন, গাছতলায় বা রাস্তার মোড়ে বা হাটবারে হাটখোলার পাশে, তার একটা লিস্ট বানানো খুবই কম সময়ের সহজ কাজ। তার পর তাঁদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য বরাদ্দের পরিকাঠামো নিশ্চয় তৈরি করা যাবে।
কথাটা আমার মাথায় গেড়ে বসেছে এক নিশ্চিত ধারণা থেকে। ধারণাটা তৈরি হয়েছে এক ঐতিহাসিক পর্বের অভিজ্ঞতায়।
বিনিয়োগ মানেই বড় শিল্প, বড় শিল্প মানেই উন্নয়ন, উন্নয়ন মানে আগে পরিকাঠামো, পরিকাঠামো মানেই ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, আইএমএফ, এশিয়ান ব্যাঙ্ক, জাপানি ব্যাঙ্কের কাছ থেকে হাওলাত (পরিকাঠামো কিসের সেটা তো সাব্যস্তই হয়নি, কিন্তু ‘পরিকাঠামো’র নামে ফ্লাইওভার, বাইপাস, নতুন নতুন ব্রিজ, দুই-লেনের রাস্তাকে ছ’-লেন, আট-লেন করা এটা ঠিক হয়ে গিয়েছে, সুকুমার রায়ের চৌধুরীদের শামিয়ানার মতো), এমন একটা আজগুবি, আপাদমস্তক অবাস্তব, উদ্ভট ‘উন্নয়ন’-এর ধারণা— আমেরিকার আর্থিক সংস্কার (নতুন নাম ‘নিয়ো লিবারাল ইকনমি’) ভায়া ইউপিএ-১’এর মনমোহন সিংহ, ভায়া তাদের শরিক বামফ্রন্ট-সিপিআই(এম), পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট আমলেই শিকড় গেড়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসও সেই ভূতের মায়ের শ্রাদ্ধ করছে।
পশ্চিমবঙ্গে কোনও বড় শিল্প বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা কম। সিঙ্গুরে টাটাকে তাড়ানোর পর পৃথিবীর, হ্যাঁ, পৃথিবীর কোনও মাঝারি বিনিয়োগকারীও পশ্চিমবঙ্গমুখো হবেন বলে মনে হয় না। ন্যানো-প্রকল্প গুজরাতে ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও ন্যানোর একই দশা ঘটত। সেটা তো টাটার ব্যাপার। কিন্তু টাটা যেখানে উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে তোলে (ফ্যাক্টরি), অন্য মাঝারি বিনিয়োগকারীও তাতে উৎসাহ ও সাহস পেতেন।
আমাদের নিজেদের পায়েই দাঁড়াতে হবে। সেই কারণেই যেখানে যত রকম উৎপাদনশীল দক্ষতা আছে, তাকে ব্যবহার করতে হবে।
যেমন উত্তরবঙ্গে জমি-মানুষ অনুপাত খুব ভাল। চা বাগানগুলি জমি নিয়ে ডাকাতি করে।
১) চা বাগানগুলির জমি নথিপত্র-সহ অডিট হোক। তা হলে বহু জমি উদ্ধার হবে। ২) উত্তরবঙ্গে এই সহায়ক কেন্দ্র একটি নয়, তিনটি দরকার। প্রথমটি মালদহ-বরিন্দ্ এলাকার জন্য। দ্বিতীয়টি মধ্য ডুয়ার্সের জন্য। তৃতীয়টি দার্জিলিঙের তরাই অঞ্চলের সন্নিহিত।
উত্তরবঙ্গের নদীর বালিতে সোনা ফলে। অথচ চা বাগান ছাড়া সেখানে কোনও বিনিয়োগী শিল্প নেই। সরকারকে আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বিনীত অনুরোধ করতে চাই— উত্তরবঙ্গের শিল্পায়ন নিয়ে নতুন করে ভাবুন। ভাবছেনই যখন।