রাজধানীর রাজনীতিতে উত্তাপ কিছুটা প্রশমিত। তৃতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে অরবিন্দ কেজরীবালের শপথগ্রহণ সম্পন্ন। নির্বাচনী প্রচারপর্বের তিক্ত পরিবেশ আপাতত অতীত। শপথগ্রহণ উপলক্ষে সংসদীয় সৌজন্যের সুস্থ অনুশীলন, নিতান্ত আনুষ্ঠানিক হইলেও, সাধুবাদের যোগ্য। কিন্তু ভুলিলে চলিবে না যে, প্রদীপের নীচে নহে, চারিপাশেও অন্ধকার জমিয়া আছে। পুলিশি নির্যাতনের শিকার হইয়া জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার একাধিক ছাত্রছাত্রী এখনও হাসপাতালে ভর্তি। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশের ঠিক আগের দিনটিতেই নৃশংস ভাবে তাঁহাদের সংসদ অভিযান দমন করিয়াছে দিল্লি পুলিশ। যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠিয়াছে বাহিনীর বিরুদ্ধে। নির্বাচনী ফলপ্রকাশের সমারোহে সেই সংবাদ অনেকটাই আড়ালে চলিয়া গিয়াছিল, কিন্তু তাহা সংবাদ-পরিসরের সমস্যা, তাহাতে ঘটনার গুরুত্ব কিছুমাত্র কমে না। এই ঘটনায় নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের উপর দিল্লি পুলিশের আক্রমণের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নূতন অধ্যায় সংযুক্ত হইয়াছে। লজ্জাকর কলঙ্কের অধ্যায়। গভীর উদ্বেগেরও। রাজধানীর আইনশৃঙ্খলার রক্ষীরা আরও এক বার বুঝাইয়া দিয়াছে যে, তাহারা আইন বা শৃঙ্খলা, কোনওটির প্রতিই দায়বদ্ধ নহে।
তবে তাহাদের দায় কাহার প্রতি? কিসের প্রতি? মনে রাখা দরকার, দিল্লি পুলিশ দিল্লির রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে না, তাহাদের উপরওয়ালা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। অর্থাৎ, তাহারা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুলিশ। সুতরাং, তাহারা যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথাযথ নিয়ম মানিয়া পরিচালনা করিবার এবং জনতার বিশ্বাসভাজন হইবার পরিবর্তে উপরওয়ালাকে খুশি রাখিতেই অধিক তৎপর হয়, তবে বিস্ময়ের কিছু নাই। পুলিশবাহিনী চিরকালই শাসককে তুষ্ট করিয়া চলিতে চাহে। দেশের বহু রাজ্যের অতীত এবং বর্তমান তাহার সাক্ষী। পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নহে। কিন্তু সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলেও, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের জমানায় দিল্লির পুলিশের আগ্রাসী আচরণ চরমে উঠিয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। পুলিশের অন্যায় আচরণের পশ্চাতে রাজনৈতিক কর্তাদের কোনও প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছিল বা আছে, এমন কথা নিশ্চিত করিয়া বলা চলে না। কিন্তু যাহার পুলিশ, পুলিশের অনাচারের দায় তাহাকে লইতেই হইবে।
আনুষঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সেই দায়কে বহুগুণ বাড়াইয়া দেয়। কেজরীবালেরা দিল্লি পুলিশের আচরণকে ‘বিজেপির সশস্ত্র শাখার ন্যায়’ বলিয়া অভিযোগ তুলিয়াছিলেন, তাহা কি বিনা কারণে? জেএনইউয়ের ঘটনায় পুলিশের আচরণ কি নিছক অপদার্থতার ফল হইতে পারে? এতটা অপদার্থ বলিয়া তো দিল্লি পুলিশের খ্যাতি ছিল না! পুলিশের সম্মুখেই প্রকাশ্য রাজপথে গুলি চালাইয়াছিল ‘রামভক্ত গোপাল’, তাহার ফলে জামিয়ার এক ছাত্র আহত হইয়াছিলেন, এবং দিল্লি পুলিশের তৎকালীন কমিশনার অমূল্য পট্টনায়ককে ‘এক্সটেনশন’ দেওয়া হইয়াছে— কোনও কার্যকারণসূত্র নাই? বস্তুত, কেজরীবালদের অভিযোগ খারিজ না করিয়া নির্বাচনী প্রচারের পর্বে তাহাকে মান্যতা দান করিতেই যেন অধিক তৎপর ছিলেন অনুরাগ ঠাকুর বা প্রবেশ শর্মার ন্যায় বিজেপি নেতারা— তাঁহারা সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের প্রতি যত গালিগালাজ করিয়াছেন, তাহার উপর তত সরাসরি আক্রমণ হানিয়াছে সমাজবিরোধীরা, ততোধিক ‘সক্রিয়’ হইয়াছে দিল্লি পুলিশ। সুতরাং পুলিশের সাম্প্রতিক অনাচারের দায় অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বর্তায়। সমস্ত ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দায় দোষী পুলিশকে শাস্তি দানের দায়। সর্বোপরি, অবিলম্বে পুলিশ বাহিনীর আচরণ সংশোধনের দায়। কিন্তু— নির্বাচনী জনাদেশে পর্যুদস্ত হইবার পরেও— বর্তমান শাসকরা সেই দায় স্বীকার করিবেন, এমন আশা বোধ করি বাতুলতার নামান্তর।