এই দেশে আমরা পাখির ডাকে ঘুমাইয়া, পাখির ডাকেই জাগিয়া উঠি— বলিবার দিন ক্রমে ফুরাইতেছে, কারণ দেশ জুড়িয়া পাখির সংখ্যা এবং স্থানিক বণ্টনের (কোন স্থানে তাহাদের ঘনত্ব কত) এক বিস্তৃত সমীক্ষায় দেখা গেল, গত দুই দশকে ভারতে পাখির সংখ্যা কমিয়াছে। অরণ্যের পাখি, তৃণভূমির পাখি, শিকারি পাখি এবং অধিক ও অনধিক দূরত্বের পরিযায়ী পাখির ক্ষেত্রে এই কথা সত্য। ভারতের বহুখ্যাত সংস্থার জীববিজ্ঞানী এই সমীক্ষায় অংশ লইয়াছেন, তথ্য সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহার সহিত প্রায় ১৫,৫০০ পক্ষী-পর্যবেক্ষক গত ছয় বৎসর ধরিয়া এক কোটিরও উপর তথ্য ‘আপলোড’ করিয়াছেন, দুই লক্ষ নির্দিষ্ট স্থান হইতে। মোট ২৬১টি প্রজাতির ক্ষেত্রে সংখ্যা হ্রাস/বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা নির্ণয় করা গিয়াছে। তাহাদের মধ্যে ১৩৬টির সংখ্যা ও বণ্টন কমিয়াছে (২০০০ সালের তুলনায়), আর ৫৮টির হ্রাস পাইতেছে তীব্র গতিতে। ১২টি প্রজাতির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী গতি দেখা গিয়াছে।
একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব মুখে মুখে ঘুরিয়া থাকে, মোবাইলের স্তম্ভগুলির বিকিরণের ফলে চড়াই পাখি মারা গিয়াছে অনেক। কিন্তু এই সমীক্ষা সেই গল্পগাছা খারিজ করিয়া জানাইল, গত ২৫ বৎসর ধরিয়া দেশব্যাপী চড়াইয়ের সংখ্যা প্রায় একই রহিয়াছে। যদিও ছয়টি বৃহৎ শহরে— কলিকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, হায়দরাবাদ ও মুম্বই— তাহাদের সংখ্যা খুব ধীরে হ্রাস পাইতেছে। ইগল, বাজ, শকুন এবং এই গোত্রের পাখিদের সংখ্যা গত দুই দশক পূর্বে যাহা ছিল, আজ অর্ধেক হইয়া গিয়াছে। শকুনের সংখ্যাহ্রাসের কারণটি অদ্ভুত। ১৯৯০-এর দশক হইতে তাহাদের সংখ্যা অকস্মাৎ প্রবল ভাবে কমিতে শুরু করিলে, বৈজ্ঞানিকেরা কারণ অনুসন্ধান করিতে গিয়া দেখেন, গবাদি পশুদের চিকিৎসা করিবার জন্য ‘ডাইক্লোফেনাক’ নামে একটি ঔষধ ব্যবহার করা হইতেছিল। সম্প্রতি এই ঔষধ দিয়া চিকিৎসা করা হইয়াছে, এমন পশু মারা গেলে, তাহার শবদেহ খাইয়া শকুনের বৃক্ক ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছিল এবং শকুন মারা যাইতেছিল। ২০০৬ সালে এই ঔষধ ভারতে নিষিদ্ধ হয় ও এমন ঔষধ দিয়া গবাদি পশুর চিকিৎসা চলিতে থাকে যাহা শকুনের পক্ষে ক্ষতিকর নহে, কিন্তু তাহাতে এখনও উল্লেখযোগ্য ফল হয় নাই। অথচ শকুনের সংখ্যা হ্রাসের ফলে বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন, জন্তুর (অভুক্ত) শবদেহ বহু স্থানে পচিতেছে ও পানীয় জলেও তাহার দেহাবশেষ মিশিতেছে। শকুনের সংখ্যা হ্রাসের ফলে ইঁদুর ও বন্য কুকুরের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাইতেছে।
পক্ষিবিষয়ক সমীক্ষা কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেই কথাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা জরুরি। পৃথিবীতে সকল প্রাণীর সমানাধিকার, মানুষ নিজের স্বার্থে অন্যান্য প্রাণীর জীবন বিপন্ন করিলে তাহা ঘোর অনৈতিক— এই প্রাথমিক পাঠটির কথা যদি বাদও রাখা হয়, তাহা হইলেও স্পষ্ট, বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের নিজের স্বার্থেই অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্বরক্ষা জরুরি। শকুনের উদাহরণটি যে কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। জীববৈচিত্র রক্ষা করিতে হইলে সর্বপ্রথম কর্তব্য, বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজ নেওয়া; অতীত হইতে বর্তমানের গতি কোন অভিমুখে, তাহা বোঝা। সেই কার্যে সমীক্ষার কোনও বিকল্প নাই। বর্তমান সমীক্ষা বলিতেছে, পরিস্থিতি আশাপ্রদ নহে। এখনই তৎপর না হইলে মানুষ নিজের জন্য আরও এক দফা বিপর্যয় ডাকিয়া আনিবে। সমীক্ষার ফলকে মান্যতা দিয়া ভুল সংশোধনের কাজ আরম্ভ করা বিধেয়।