তিনি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতিকেই শুধু বিকৃত করেননি, কবিতাটিরও (জয়সীর পদ্মাবৎ) ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।’— এই ‘তিনি’ হলেন চিত্র পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভন্সালী, বিষয় বিতর্কিত ছবি ‘পদ্মাবতী/ৎ’, চিঠির লেখকের নাম মহেন্দ্র সিংহ। কে মহেন্দ্র সিংহ? তিনি রাজনীতিক, চিতোরগড় থেকে নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় গিয়েছিলেন। তা হলে পদ্মাবতী/ৎ নিয়ে তাঁর এই লেখালিখি কেন? কারণ তিনি মেবারের রাজপরিবারের সদস্য। পারিবারিক নীল রক্ত গণতান্ত্রিক ভারতে দাঁড়িয়ে তাঁকে ইতিহাস সংস্কৃতি কবিতা কেমন হওয়া উচিত বা উচিত নয়, সে বিষয়ে বিধান দেওয়ার অধিকার দেয়!
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী স্মৃতি ইরাণীর কাছে মেবারের রাজপরিবারের পক্ষ থেকে এই ছবি নিয়ে এটি তৃতীয় চিঠি। নানান ‘সেনা‘র আক্রমণ, নাক কান গলা কাটার ফতোয়া, রাজপুত আবেগ ইত্যাদির সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজপরিবারের অভিভাবকত্ব। শুধু মহেন্দ্রবাবুতেই রক্ষে নেই, তাঁর ছেলে বিশ্বরাজ বললেন, ‘নাম পালটানোর মতো সামান্য কিছু বদল করলে ছবিটি বদলে যায় না।’ বিজেপি বিধায়ক, রাজকুমারী দিয়া প্রশ্ন তুললেন, ‘ছবি করার আগে কেন রাজপরিবারকে জিজ্ঞেস করা হয়নি?’
সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান বিশেষ প্যানেল বানিয়ে ছবিটি দেখিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তাতে সিনেমার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন ছিলেন, রাজপরিবারের অরবিন্দ সিংহও ছিলেন। ছিলেন জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দু’জন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। পাঁচটি সংশোধনসহ নাম বদল করে শেষে ছবিটিকে মুক্তির ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তবুও সমস্যা মিটছে না। কেন? কারণ দুই প্যানেল সদস্য নাকি এই সিদ্ধান্তে হাত তোলেননি। গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যাগুরুর সিদ্ধান্তই তো বলবৎ হয়। সকলের ঐকমত্য কি সম্ভব? নির্বাচনে একশো শতাংশ ভোট না পেলে কি সরকার বাতিল হয়?
দুটো প্রশ্ন খুব সংগত কারণেই মাথায় আসছে। প্রথমত, যে চরিত্র বহুকাল আগের একটা সময়কে প্রতিফলিত করে, যা কিছু ইতিহাস কিছু কবিতা কিছু কল্পনায় একাকার হয়ে গিয়েছে, নিজের ধরনে তার পরিবেশনার ব্যক্তিস্বাধীনতা গণতান্ত্রিক দেশের পরিচালকের থাকবে না? নাগরিকরা মুক্তমনে তাঁর ভাবনার স্বাদ পেতে পারবেন না? সরকার ছবির নির্মাতা ও দর্শককে কেন সেই নিরাপত্তা, সেই স্বাধীনতা দিতে ব্যর্থ হবেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, যে চরিত্র এখন ইতিহাস বা মিথ কিছু একটা হয়ে গিয়েছে, তার পরিবেশনায় কি পরিবারের অভিভাবকত্ব থাকা উচিত? আজ যদি কবি মালিক মহম্মদ জয়সীর কোনও বংশধর এসে আর এক রকম দাবি করে বসেন, আবার কি বিতর্ক, রাজনীতি, আক্রমণ, ফতোয়া শুরু হবে? রবি ঠাকুরের কবিতার ব্যাখ্যা করতে গেলে কি আমাদের ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের অনুমতি নিতে হবে? আইনস্টাইনের জীবনী লিখতে গেলে তাঁর নাতিপুতির সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে? যদি চরিত্র সত্যিই ঐতিহাসিক হয়, তবে তার সম্মান বা স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দায় আর পরিবারের ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। সে তখন দেশের সম্পদ, যে দেশের আসল চালক জনগণ এবং সংবিধান। পরিবারের সদস্যরা অবশ্যই সহায়তা দেবেন, সমালোচনা করবেন। কিন্তু শিল্পসাহিত্যের মতো সৃষ্টিমূলক বিষয়ে তাঁদের নিয়ন্ত্রকের অধিকার দেওয়া চলে কি? রাষ্ট্র কি এ অধিকার তাঁদের দিয়েছে?
রাজপুতানার সবাই এক ভাষায় কথা বলেননি। কংগ্রেসের মন্ত্রী হওয়া বুন্দি রাজপরিবারের জিতেন্দ্র সিংহ বলে ফেলেন, ‘এই ভ্যান্ডালিজম এবং শারীরিক আক্রমণের ফতোয়া রাজপুত সংস্কৃতির বিরোধী’। রানা রতন সিংহের বংশধর অরবিন্দ সিংহ নিজে প্রথমে আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন। রাজপুত রাজনীতির গোলকধাঁধায় পড়ে দু’জনেই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যান। অরবিন্দবাবু তো সেন্সর বোর্ড চেয়ারম্যানের ইস্তফাই চেয়ে বসেন।
মহেন্দ্র সিংহ বলেছেন, ‘আমাদের রাজপুতদের শ্রীযোশীর কাছ থেকে কোনও শংসাপত্রের দরকার নেই’। স্বাধীন ভারতে পরিচালককেই বা তবে মেবারের রাজপরিবারের শংসাপত্র নিতে হবে কেন? আর কবে এই নীলরক্তের মানুষরা বুঝবেন, এ দেশ থেকে রাজতন্ত্র ধুয়ে মুছে গেছে? রাজার কেল্লা, তখত-এ-তাউস এখন টুরিস্টের দ্রষ্টব্য, যাদের রক্ষণাবেক্ষণ হয় সাধারণ নাগরিকের দেওয়া করের টাকায়! আজকের পদ্মিনীরা কী করবেন, জয়সীরা কী লিখবেন, ভন্সালীরা কী দেখাবেন, দর্শকরা কী ভাববেন, সে তাঁদের ব্যাপার। রাজাবাহাদুরের রক্তচক্ষুর পরোয়া আজ আমরা করি না।