লকডাউনের মধ্যে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমতে কমতে মাঝে এক দিন শূন্যের নীচে নেমে গেল। আবার, জে কে রাওলিং জানালেন, ছোটদের জন্য লেখা তাঁর নতুন উপন্যাস ‘ইকাবগ’ ১০ জুলাই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন— বিনামূল্যে পড়া যাবে বইটি।
এ তো ভারী আশ্চর্যের কথা! তেল কিনলে বিক্রেতাই আবার হাতে কিছু নগদও দিয়ে দেবেন, বেস্টসেলার লেখক তাঁর আনকোরা উপন্যাস পড়তে দেবেন বিনামূ্ল্যে— অচ্ছে দিন কি তা হলে এসেই গেল? না, সবই বাজারের খেল। তেলের বাজারে এখন একটা ‘ডিমান্ড শক’ চলছে— লকডাউনের ফলে লোকে বেরোচ্ছে না, তাই তেলের চাহিদাও তলানিতে। অথচ, লকডাউনের আগে উৎপাদিত বিক্রি না হওয়া তেল রাখার খরচ তো আছে। অগত্যা তেলের দাম ঋণাত্মক; ক্রেতা নিলে বরং পয়সা পাবেন। রাওলিংয়ের ক্ষেত্রেও বাজারের শর্ত কাজ করে, তবে এখানে ধাক্কাটা ঠিক লকডাউন থেকে আসেনি, এসেছে প্রযুক্তির উদ্ভাবনে— কোভিড-১৯ না এলেও অনলাইন আসতই। শুধু রাওলিং কেন, ‘গুলাবো সিতাবো’-র মতো ছবি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দেখাতে খোদ বচ্চনকেও আয়ুষ্মান খুরানার সঙ্গে মেকি ঝগড়া করে বিজ্ঞাপন দিতে হয়।
গান, সিনেমার জগতের অনেক শিল্পীরই এখন চিন্তা, এর পরে ‘নিউ নরম্যাল’ দুনিয়ায় আর কোনও দিনই কেউ পয়সা দিয়ে গান শুনবেন না, সিনেমা দেখবেন না, বই পড়বেন না। শুনছি, অনেকেই বাজার অর্থনীতিকে দোষী ঠাওরেছেন। এই প্রসঙ্গে দুটো কথা মনে রাখা ভাল। ভাববেন না অনধিকার চর্চা করছি— এটা শুধু শিল্পীদের সমস্যা নয়; খেলোয়াড়, শিক্ষক অনেকেই ভাবছেন, চাকরি চলে গেলে ইউটিউব-ই খেতে দেবে। বিনোদনের ব্যবসা-বিপণন না করলেও বুদ্ধিজীবীদেরও তাঁদের জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি, চিন্তাভাবনা বেচেই খেতে হয়। বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে হলেও তাতে পেট চলে না— লেখাপড়া করে গাড়িঘোড়া চড়ার সুযোগ বাজারি অর্থনীতি না থাকলে হয়তো হত না।
মুশকিল হল, আমরা ধরেই নিই যে বাজারই সব কিছুর মূলে— কাজেই ধনতন্ত্র, ভোগবাদ, বেসরকারিকরণ, সরকারি সম্পত্তি বিক্রি, এমনকি বিশ্বায়নকেও আমরা বাজারি মূল্যায়নের প্রতিশব্দ মনে করি। সমাজতন্ত্র না ধনতন্ত্র, ভোগবাদ না কমিউনিজ়ম, সে তর্ক এখন তোলা থাক। অর্থনীতিবিদদের অন্যতম কাজ হল সমাজে সীমিত আবহের মধ্যে বণ্টনব্যবস্থা নির্ধারণ করা। সকলে যা চাই তার কোনও কিছুই অঢেল নয়, তাই আদর্শ ব্যবস্থা মেলা ভার। এর মধ্যে একটা পদ্ধতি হল ‘মার্কেট প্রাইস মেকানিজ়ম’, অর্থাৎ বাজারের প্রক্রিয়ায় মূল্য নির্ধারণ। তবে, এটাই একমাত্র পদ্ধতি নয়— বেচাকেনার বদলে বিনিময় চলতেই পারে।
কিন্তু, পারস্পরিক পিঠ চাপড়ানিতে তো পেট ভরে না— একে অন্যের পোস্টে ‘লাইক’ দেওয়া মুদ্রা-বিনিময়ের বিকল্প হতে পারে না। মূল্য-র মতো কোনও মানদণ্ড দরকার, তাই টিআরপি, পেজ-সাবস্ক্রিপশন বা ফলোয়ার বাড়ানোর এত হিড়িক; সরাসরি পয়সা দিয়ে বা না দিয়ে এ ভাবে মূল্যায়ন করে বাজার, দর্শক-শ্রোতা, অনলাইন বিজ্ঞাপনদাতারা। কেউ নাক সিঁটকাতেই পারেন, কিন্তু চাহিদা-জোগানের মিঞা-বিবি রাজি হলে প্রাচীনপন্থী কাজিদের সত্যিই কিছু করার নেই।
সৃষ্টিশীলতার বাজার না থাকলে তার বদলে সমবায় গড়া অথবা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার আশায় হাত পাতা বা পা চাটা কি দুর্বলতার লক্ষণ হত না? বিলেতের মতো দেশে ডাক্তারদের মাইনে সরকারের গড়া ট্রাস্টের মাধ্যমে এলেও সবাই বাজারদরই পান, মুড়ি-মুড়কির এক দর হয় না। আবার, যে কোনও শিল্পী বা শিল্পসংস্থা চ্যারিটি-র মর্যাদা ও তজ্জনিত সুযোগসুবিধা পান। তাও, টিকিটের দামের জন্য বাজারই একমাত্র ভরসা।
দুই, বাজার ভাল না খারাপ, সেই বিচারের মানদণ্ড কী? এখানে ‘ভাল’ শব্দের মানেই বা কী? আপাতদৃষ্টিতে কাম্য ব্যবস্থা, এমনকি সমবণ্টনও, ক্ষেত্রবিশেষে কাজের নয়। ভাল মাপকাঠির এক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন উনিশ শতকের দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ উইলফ্রেড প্যারেটো। তাঁর মতে, সমাজের সকলের উন্নতিই কাঙ্ক্ষিত; কয়েক জনের ধন অনেক বাড়ল, কিন্তু তার ফলে কয়েক জনের কিছুটা হলেও কমল, সেটা মোটেই কাম্য নয়। বাজারি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হল, বাজারের ফলে আমরা যা পাই সেটা এহেন ‘প্যারেটো-এফিশিয়েন্ট’— এই উপপাদ্যটি ‘ওয়েলফেয়ার থিয়োরেম’ নামে খ্যাত। বাজারে বিশ্বাস রাখার পক্ষে বেশ জোরালো যুক্তি।
তবে, বাজার কাজ না করলে বা ফেল করলে সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার বইকি। কিন্তু, চানের পরে গামলার নোংরা জলের সঙ্গে শিশুটাকেও ফেলে দেওয়া চলে না— ভ্রম রুখতে পুরো দ্বার বন্ধ করে দিলে হয় না। বাজার থাকবেই, অতএব বাজারের ওঠাপড়াও থাকবে; বাজারকে আক্রমণ না করে বরং নিয়ন্ত্রণ করা যাক।
লকডাউন উঠে গেলে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গাইতে গাইতে হাহুতাশ করা অর্থহীন।
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়