কোন পথে বাংলা ভাষা? লাভ কী এই বকচ্ছপ-রূপে?

ভাষা অত ঠুনকো নয় যে, তা ভিন্ন শব্দের অনুপ্রবেশে মরে যাবে। কিন্তু ভাষার জগাখিচুড়ি চেহারায় হারিয়ে যায় মূল সুর। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে লিখছেন অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ভাষা অত ঠুনকো নয় যে, তা ভিন্ন শব্দের অনুপ্রবেশে মরে যাবে। কিন্তু ভাষার জগাখিচুড়ি চেহারায় হারিয়ে যায় মূল সুর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:০০
Share:

ভাব থেকেই ভাষার উদ্ভব। আবার, ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম ভাষাই। তাই ভাব ও ভাষার সম্পর্ক গভীর এবং অবিচ্ছেদ্য। অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হিসেবে মানুষের উন্নত অবস্থান অনেকাংশে ভাষার সূত্রেই।

Advertisement

মনুষ্য সমাজের অন্যতম সংযোজক সূত্র ভাষা। তাই সমাজ পরিবর্তনের ছাপ ভাষা ধারণ করবে, সেটিই স্বাভাবিক। ভাষা বিশ্লেষণ করে একটি সমাজ বা গোষ্ঠীর চারিত্রিক বিশ্লেষণও নিপুণ ভাবে করা সম্ভব। মানবগোষ্ঠীর মতো ভাষাও নানা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন নিজের অবয়বে গ্রহণ ও আত্তীকরণ করেই সমৃদ্ধ আর সচল থাকে। পৃথিবীতে যে কোনও শক্তিশালী ভাষার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়ে থাকে। কিন্তু ভাষার যে মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাকে অক্ষুণ্ণ ও বহমান রাখার দায়ও তার উপর বর্তায়। এ দায় আমাদেরই। যে কোনও ভাষারই সহজাত প্রবণতা ও ক্ষমতা থাকে অন্য ভাষা থেকে শব্দ আত্মসাৎ করার, ঋণ গ্রহণ করার। কিন্তু সেই প্রবণতায় নিয়ন্ত্রণ না থাকলে নিজেরই ক্ষতি হয় বেশি। কারণ, প্রবল আশঙ্কা থাকে একদিন নিজের চেহারা বকচ্ছপের নিজের কাছেই অচেনা হয়ে ওঠার।

ভাষা যেহেতু বলা ও শোনার মধ্যে দিয়েই উৎপন্ন, তাই কথ্য ভাষা জলের মতো আধারহীন। তাকে চিহ্ন বা সংকেতের মধ্যে দিয়ে লিপিরূপ দেওয়া থেকেই লিখিত ভাষার জন্ম। এই লেখ্য রূপই চোখে দেখার। শব্দবিদ্যা এই দু’য়েরই মিলিত রূপ। বাঙালি বাংলা ভাষা লিখে আসছে প্রায় হাজারখানেক বছর ধরে। সংস্কৃত ব্যাকরণ রীতি পাঠ করেই বাংলা লিখিত ভাষার চর্চা শুরু হয়েছিল। উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষার যে সর্বসম্মত ব্যাকরণ লিখেছিলেন, তা মূলত সাধু ভাষার ব্যাকরণ। কিন্তু কথ্য বাংলা ভাষার কোনও নির্দিষ্ট একটি চেহারা নেই এবং হতেও পারে না। বঙ্গদেশের বিভিন্ন জেলার কথন-বৈচিত্র, বিবিধ উচ্চারণ-রীতি, বাক্য-গঠনের বিভিন্নতা, শব্দে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব, ধর্ম-জাতি-জীবনচারণের সূক্ষ্ম প্রভাব উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলা ভাষার শরীর গঠন করেছে। ভাষা রাজনৈতিক মানচিত্রের সীমারেখা মেনে চলে না। ভাষা আঞ্চলিক কথন-কাঠামোয় প্রভাবিত প্রবহমাণ ঐতিহ্য। তাই অবিভক্ত বঙ্গদেশের সব প্রান্তের, সব অঞ্চলের ভাষার বিচিত্র তারতম্য মিলেমিশে তৈরি করেছে বাংলা ভাষার অবয়ব। এ ভাবেই বাংলা ভাষার বহমানতা, সমৃদ্ধি, ব্যাপ্তি ও বিকাশ।

Advertisement

কিন্তু একই সঙ্গে ভাষার অস্তিত্বসঙ্কটের প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। এ নিয়ে ‘গেল-গেল’ রব অবশ্য খুব বেশি দিনের নয়। আসলে, ভাষাকে নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু মূল নদীখাতটিকে বাদ দিয়ে যদি জলরাশি তার শাখা-প্রশাখা বা উপনদীর মধ্যে দিয়েই বইতে থাকে, তবে একদিন গোটা নদীরই মৃত্যু হয়। বাংলা ভাষার গতিশীলতাকে মাঝেমাঝে শাখাপ্রশাখা-প্রবল হয়ে উঠতে দেখেই সমাজে আশঙ্কার মেঘ জমে ওঠে। এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, প্রচলিত মূল ধারার বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি ছাঁচ অনেক দিনের আমদানি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের প্রবণতা বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার ক্রিয়াপদের মিশ্র ব্যবহার। যেমন— ‘ফোন’ করব শব্দটির নতুন প্রয়োগ ‘ফোনাব’ বা সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে ‘ট্যাগানো’ (‘ট্যাগ’ করার বদলে) কথ্য বাংলায় অনায়াসে জায়গা করে নিচ্ছে। চিঠি পোস্ট করার অনুষঙ্গ ধার করে ‘স্ট্যাটাস’ বা ছবি পোস্ট করা অথবা ‘আপলোড’ করার কথাও বলা যায়। এ রকমই অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, যা টেবিল-চেয়ারের মতোই এখন বাংলা শব্দভাণ্ডারে ঢুকে পড়েছে।

এমনিতে এতে অসুবিধা থাকার কথা নয় তেমন। বিদেশি শব্দ চিরকালই ছিল, আছে এবং থাকবে পৃথিবীর যে কোনও ভাষায়। কিন্তু গত দু’দশকে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন এসেছে নতুন প্রজন্মের বড় অংশের কথ্য বাংলায়, যে জগাখিচুড়ি ভাষা শুনলে বুঝে ওঠা যায় না, আসলে কোন ভাষায় কথোপকথন চলছে। ইংরেজি বা হিন্দি ভাষার আধিপত্যের প্রশ্ন এখানে বিবেচ্য নয়। এই দুই ভাষার যে কোনও একটিতে দক্ষ হলে বা সহজে তা বলা ও লেখার ক্ষমতা থাকলে তা শ্রুতিমধুর এবং প্রশংসনীয়ই। এ কথাও গুরুত্বপূর্ণ যে, বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ আর ভারত এই দু’য়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রাদেশিক ভাষাগুলোয় অবশ্যম্ভাবী ভাবেই অনুপ্রবেশ ও প্রয়োগ ঘটছে প্রচুর তথাকথিত বিদেশি শব্দবন্ধের। ভাষা ও শব্দ তো সমার্থক নয় এবং ভাষার বিরাট ক্ষতিও হয় না এই ঘটনায়। বরং কিছু ক্ষেত্রে নমনীয়ই হয় তার ব্যবহার।

কিন্তু অস্বস্তিটা তার গড়নের অদ্ভুতুড়ে জগাখিচুড়ি-মার্কা চেহারা নিয়ে, যেখানে হারিয়ে যায় ভাষার লালিত্য, মাধুর্য ও যাবতীয় ইতিহাসও। ভাষা ভাব আদানপ্রদানের মাধ্যম বলেই তার কাঠামো ভেঙে-মুচড়ে বিকৃত রূপ দিয়ে দেওয়ার পক্ষে কোনও যুক্তিই নেই বোধ হয়। ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠনের জন্য নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা পড়ে না বলে দোষারোপ যতটা করা হয়, মাধ্যম নির্বিশেষে কথ্য ভাষাটা অন্তত ঠিক ও শ্রুতিমধুর করার দিকে নজর ততটা চোখে পড়ে না।

তাই পথেঘাটে এমন কথোপকথন শোনা যায়— ‘আমাকে লাগছে কি, ইট উইল রেন টুডে! ইউ নো, আজকে উইথ ফুল মস্তি ভিজব! কেন-কি আজকে তো আমি ফরগট মাই ছাতা!’ বাংলা বিজ্ঞাপনে হিন্দি মিশ্রিত অর্থহীন বাক্যগঠন বা বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালে আঞ্চলিক ভাষার নামে সম্পূর্ণ মনগড়া বিকৃত বাংলার ব্যবহার বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক চলনের যে ইঙ্গিত দেয়, তাতে মনে হয় না যে, তা আদৌ কোনও উৎকর্ষের অভিমুখী।

আসলে, ভাষার সঙ্গে ভাব ছাড়াও থাকে আবেগ অার অভিমান, যাকে ক্রমাগত আঘাত করলে তার মূল সুর হারিয়ে যায়। কাগজের ফুলের মতোই তা কিছু বেশি রংচঙে আর খানিক বেশি চাকচিক্যময় হলেও তা গন্ধ এবং পেলবতা হারিয়ে কৃত্রিম হতে বাধ্য বইকী!

(লেখক ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ি উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement