ঘোর সঙ্কটে পড়ার আগে জল-সাক্ষরতা জরুরি

সার্বিক পরিবেশ-সাক্ষরতার মতো আমাদের জল-সাক্ষরতাও খুব ভাসা-ভাসা। তাই অনেক মানুষের কাছে আপাত গুরুত্বহীন মৃতপ্রায় পুকুরের পরিবর্তে অর্থনৈতিক লাভটা বড় হয়ে উঠছে। লিখছেন শুক্লা মণ্ডলএই শহরে পশ্চিম দিক বরাবর ভাগীরথী ও বহু সংখ্যক বিল থাকা সত্ত্বেও প্রতি পাড়ায় ছিল তিন-চারটি করে মানুষের তৈরি করা বড় পুকুর, যার বেশিরভাগই এখন অদৃশ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৯ ০০:২৭
Share:

বিশ্বব্যাপী জল-সঙ্কট নিয়ে পরিবেশবিদদের হুঁশিয়ারি এবং পথনির্দেশ, জল ও জলাভূমি বাঁচানো বিষয়ে দেশে শক্তপোক্ত আইন— এ সব কিছু সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এটা বহরমপুর শহর ও আশপাশে সামান্য ঘুরলেই বোঝা যাবে। জমি ও ফ্ল্যাট ব্যবসায়ীদের অতি সক্রিয়তার ফলে পরের প্রজন্মের জন্য তৃষ্ণার জলটুকুও আর অবশিষ্ট থাকছে না। শহরের রাস্তা, আলিগলি, তস্যগলি, গৃহস্থের উঠোন, চাতাল এমনকি নালা-নর্দমার তলদেশও বিলকুল পিচ ও কংক্রিটে মোড়া। জলাভূমি বা মাঠ-ময়দান ছাড়া কোথাও একফোঁটা বৃষ্টির জল মাটিতে ঢুকবে এমন উপায় নেই। কেমন আছে জলাশয়গুলি দেখা যাক।

Advertisement

এই শহরে পশ্চিম দিক বরাবর ভাগীরথী ও বহু সংখ্যক বিল থাকা সত্ত্বেও প্রতি পাড়ায় ছিল তিন-চারটি করে মানুষের তৈরি করা বড় পুকুর, যার বেশিরভাগই এখন অদৃশ্য। সেখানে মাথা তুলেছে দৈত্যাকার বহুতল আবাসন, দোকান-বাজার। এ সব ‘উন্নয়নের’ ফাঁকফোঁকর দিয়ে খুঁজলে হয়তো দেখা মিলবে মৃতপ্রায় কঙ্কালসার গুটিকয়েক পুকুর, যেগুলো মৃত্যুর জন্য দিন গুনছে। চারদিক থেকে চেপে নানা অছিলায় ভরাট করার দরুণ যে পুকুরের আকার বড় কড়াই থেকে এখন চায়ের কাপের আকার নিয়েছে। উপরন্তু এগুলি প্রায় জলশূন্য, পানা ও ঝোপজঙ্গলে ঢাকা, পাড়ে মানুষের ফেলা আবর্জনার পাঁচিল; বৃষ্টির জল গড়িয়ে পুকুরে ঢুকবে এ উপায় নেই।

সার্বিক পরিবেশ-সাক্ষরতার মতো আমাদের জল-সাক্ষরতাও খুব ভাসাভাসা। তাই অনেক মানুষের কাছে আপাত গুরুত্বহীন মৃতপ্রায় পুকুরের পরিবর্তে অর্থনৈতিক লাভটা বড় হয়ে উঠছে। সমস্ত আইনকে নস্যাৎ করে প্রশাসন ও স্বল্পসংখ্যক অর্থলিপ্সু মানুষ পুকুরগুলিকে জমি হিসেবে ব্যবহার করছে। মানুষকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

Advertisement

এখন দেখা যাক, পুকুরগুলির এই হাল হল কেন? কী ভাবে এগুলি বাঁচানো যায়? আর বাঁচানোর দরকারটাই বা কী? পুকুরগুলি শুকিয়ে যাওয়ার বহুবিধ কারণের মধ্যে প্রথম ও প্রধান কারণ হল পুকুরের কাছে নির্মিত বহুতল বাড়িগুলি নির্মাণের সময় থেকে শুরু করে এখনও অবিরাম মাটির ভিতরের জল ব্যবহার করছে। যে জল পৌরসভার সরবরাহ করা নয় এবং তার পরিমাণও অত্যাধিক। আগে যে জমিতে একটি পরিবারে পাঁচ-ছ’জন মানুষ বাস করত এখন সেই জমিতে নির্মিত বহুতলে পঞ্চাশ থেকে একশো জন থাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে পুকুর, কুয়ো এমনকি নদীতে জল থাকার অন্যতম শর্ত মাটিতে জল থাকতে হবে, এটা কোনও কল্পনাপ্রসূত তত্ত্ব নয়। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ মহারাষ্ট্রের খরা-পীড়িত অঞ্চলগুলিতে বৃষ্টির জল বাঁধ দিয়ে আটকে মাটিকে সরস করে তোলা হচ্ছে। তাতে নদী, জলাশয়গুলিতে সারা বছর জল থাকছে, চারদিকের প্রকৃতিও সবুজ হয়ে উঠছে। পুরসভা বহুতলের নকশা অনুমোদনের সময় এই শর্ত আরোপ করতে পারে যে, ছাদ ও আশপাশের বৃষ্টির জল সংলগ্ন পুকুরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, একশো-দেড়শো বছর বয়সি পুকুরগুলির সম্ভবত জন্মাবধি কোনও সংস্কার হয়নি।

ইতিমধ্যে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে হইহই করে এসে পড়েছে প্লাস্টিক যুগ। পুকুরের গর্ভে এত দিন ধরে যে বহুল পরিমাণে প্লাস্টিক আবর্জনা জমে আছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এখন উপায় পুকুরের গর্ভের দেড় ফুট পর্যন্ত জমা পাঁক তুলে ফেলে সংস্কার করা এবং পাড়ের ঢাল খাড়াইয়ের বদলে ঢালু করা। তৃতীয়ত, পাড়ে আবর্জনার স্তূপ জমানো একেবারে বন্ধ করা। চতুর্থত, আশেপাশের বাড়ির নর্দমা পুকুরে যুক্ত থাকলে তা বিযুক্ত করা। পুকুর, বিল প্রভৃতির দ্রুত মজে যাওয়ার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত জৈবপদার্থ (যা সারের কাজ করে) যা পুকুরে পড়ার ফলে কচুরিপানা-সহ অন্য পানার বাড়বাড়ন্ত ঘটায়। অল্প পরিমাণ জৈব পদার্থ পুকুরে পড়লে তা শোধন করে নেওয়ার প্রাকৃতিক ক্ষমতা জলাশয়ের থাকে। তবে তা কতগুলি শর্তের উপরে নির্ভরশীল।

পুকুরের মালিকানা যারই হোক না কেন জলসম্পদের স্বার্থে সরকার তা অধিগ্রহণ করে সংস্কার করতে পারে, এমন আইন আছে। পৌর এলাকায় প্রতি ওয়ার্ডে বছরে অন্তত একটি করে পুকুর যথাযথ ভাবে সংস্কার করলে তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হবে। অতি সম্প্রতি সেচ বিভাগ থেকে জানা গিয়েছে যে, মুর্শিদাবাদ জেলার ২৬টি ব্লকের মধ্যে ১৭টি ভূ-গর্ভস্থ জলের বিষয়ে প্রায় সঙ্কটজনক এবং মাত্র ৩টি ব্লক বাদ দিয়ে বাকি সবগুলির ভূ-গর্ভের জলে অনুমোদনযোগ্য মাত্রার থেকে বেশি আর্সেনিক মিশে আছে। এটা প্রমাণিত যে, ভূ-তলের জল (নদী, খাল-বিল, পুকুর, দিঘি) আর্সেনিক ও ফ্লুরাইড দূষণমুক্ত। আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীতে ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণ অতি সামান্য (১ শতাংশের কম)। এই সামান্য পরিমাণ জল প্রাকৃতিক জলচক্রের মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে আসছে বলে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় জল পাচ্ছি। এর মধ্যে বেশিটা (০.৭৬ শতাংশ) ভূ-গর্ভের জল, ভূ-তলের জল আরও কম (০.০০৮ শতাংশ)। দুই জলেরই উৎস বৃষ্টির জল। ভূ-গর্ভের জল হাজার হাজার বছরের সঞ্চিত ভাণ্ডার যা সহজে পূরণ হয় না। একশো বছর আগে পর্যন্ত মানুষ ভূ-তলের ওইটুকু (০.০০৮ শতাংশ) জলের ওপর নির্ভর করে বেশ চালিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির সাহায্যে ভূ-গর্ভের জলের নাগাল পেতেই, সেটাই মানুষের কাছে সবথেকে সহজে পাওয়া নিরাপদ জল বলে গণ্য হয়েছে। বেড়েছে ভূ-তলের জলের প্রতি অবহেলা। জলাশয়ের কোনও মূল্য বুঝতে পারছি না আমরা। নানা ভাবে তার মূল্য গুনতে হচ্ছে।

ভূগর্ভের জলে মিশে যাচ্ছে বিষ– আর্সেনিক, ফ্লুরাইড। আরও অন্য কিছু বিষ যে আসবে না এটা হলফ করে বলা যায় না। অথচ ভূ-তলের জল এই সব বিষমুক্ত। পৃথিবীর মোট বৃষ্টির মাত্র দশ শতাংশ পায় ডাঙা; বাকি পায় সমুদ্র। ডাঙায় পড়া বৃষ্টির এক ভাগও যদি ডাঙার জলাশয়গুলিতে বা মাটিতে আটকে ফেলা যায় তা হলে আমাদের আর জলের কোনও সমস্যা থাকবে না। ভূ-গর্ভের জলের পরিবর্তে আমাদের নির্ভরতা বাড়াতে হবে ভূ-তলের জলের উপর। জল সঙ্কট থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় জলাভূমি সংস্কার ও সংরক্ষণ।

পরিবেশকর্মী ও প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা, বহরমপুর গার্লস

মহাকালী পাঠশালা

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement