‘বিশে বিষ’ কথাটা আজকাল অনেকের মুখেই ঘুরছে। বিশ মানে দু’হাজার বিশ সাল। যা অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। করোনা অতিমারির জেরে বিঘ্নিত হয়েছে পড়ুয়াদের পড়াশোনা। কচিকাঁচা পড়ুয়াদের কলবরমুখরতার বদলে স্কুলে স্কুলে এখনও নিঃস্তব্ধতা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও স্বাভাবিক ক্লাস শুরু হয়নি। তার বদলে ক্লাস এবং যাবতীয় পড়াশোনা চলছে অনলাইনে। এমনকি পরীক্ষা ব্যবস্থাও অনলাইনেই হচ্ছে। নতুন এমন অভিজ্ঞতার কথাও তাই রয়েছে চর্চার মধ্যে। সামনে ইংরেজির নতুন বছর, বিশের ‘বিষ’ সরিয়ে আবার একটা নতুন, সুন্দর সকালের প্রত্যাশার কাউন্টডাউনও হচ্ছে। যে দিন স্কুল প্রাঙ্গণ ভরে যাবে আবার কচিকাঁচাদের সেই চেনা কলতানে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মুখরিত হবে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে। চেনা ছন্দে ফিরবে শিক্ষা ব্যবস্থা। দার্জিলিং থেকে দলসিংপাড়া, কোচবিহার থেকে কুমারগ্রাম, মালদহ থেকে মালবাজার, বালুরঘাট থেকে বাবুরহাট উত্তরের সর্বত্র যেন তেমনই আশা।
অবশ্য এমনটাই স্বাভাবিক। গোটা বছর জুড়েই যে পড়ুয়াদের অনেক ইচ্ছে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। অভিভাবকদের অনেকের মুখেও তা নিয়ে আক্ষেপ ঝরছে। তাঁদের একজন বলছিলেন, “ আমার ছেলে ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে পড়ছে। ক্লাস টু। ফাইনাল পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরেই নতুন স্কুল ব্যাগ, জলের বোতল আর টিফিন বক্সের বায়না জুড়েছিল। স্কুলের নতুন পোশাকও আনা হয়। কিন্তু দেখুন, পুরো বছরটা শেষ হতে যাচ্ছে একদিনও স্কুল যেতে পারল না। এতে তো আমাদেরও খারাপ লাগে। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে কারও তো কিছু করার নেই।” আবার সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের কয়েক জন অভিভাবকের বক্তব্য, “স্কুলে ক্লাস করার মতো অবস্থা এ বার ছিল না। অথচ সামনেই জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। সেই মাধ্যমিকের প্রস্তুতি কেমন হয়েছে, সেটা যাচাই করে নিতে টেস্ট পরীক্ষাটাও করোনা পরিস্থিতিতে সম্ভব হল না। গত উচ্চ মাধ্যমিকের একাধিক পরীক্ষাও করোনার জন্য বাতিল হয়েছিল। সত্যিই বিশ সালটা একেবারে বিষময় হয়েছে।”
শুধু কী তাই? কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীরাও কিন্তু এ বছর কম হ্যাপা পোহায়নি। অনলাইনে পরীক্ষা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই অফলাইনে উত্তরপত্র জমা দিতে ছুটতে হয়েছে তাদের। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজের কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতটাও কি কম ব্যাপার! সব মিলিয়েই তাই নতুন বছরে দুর্ভোগ কেটে যাওয়ার প্রত্যাশা। করোনা মুক্ত এ এক নতুন দিনের অপেক্ষায় সবাই। আলোচনা শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন নিয়েও। কবে ভ্যাকসিন মিলবে তা অবশ্য এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে বিভিন্ন জেলায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ পদ্ধতি থেকে মজুত রাখার পরিকাঠামো তৈরি রাখার একটা হোমওয়ার্ক শুরু হয়েছে। তাই একটা আশার আলো দেখছেন অনেকেই। কিন্তু যত দিন ভ্যাকসিন না আসছে, তত দিন কিন্তু সতর্কতায় খামতি রাখা যাবে না, বলছেন বিশেষজ্ঞদের বেশিরভাগই। বিশেষ করে শীতের মরসুমে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়েও একটা আলোচনা রয়েছে। ব্রিটেনে করোনা ভাইরাসের একটি নতুন ‘স্ট্রেন’ পাওয়া গিয়েছে। তা নিয়েও উদ্বেগের পারদ আবার বাড়তে শুরু করেছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্রিটেনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। আশা, উদ্বেগের এমন দোলাচলের মধ্যে কড়া নাড়ছে ইংরেজি নতুন বছরের আগমনী। আমাদের দেশে জানুয়ারি থেকে অবশ্য টিকাকরণের লক্ষ্যমাত্রা রেখে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবু একুশের শুরুতে কি স্কুল খুলবে? প্রশ্নটা ঘুরছে।
অনেকেই অবশ্য বলছেন, জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই। ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই সব দিক ভেবেচিন্তেই নিশ্চয়ই ওই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। অহেতুক ভাবনাচিন্তা করার মানে হয় না। পরিস্থিতিটা বুঝতে হবে। সকলেরই দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে ওই ব্যাপারে সহযোগিতাও করা উচিত। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কোচবিহারের প্রতিনিধি মিঠুন বৈশ্য বলেন, “অতিমারি পরিস্থিতিতে সবসময় ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য,নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই রাজ্য সরকার, পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই স্কুল খোলার ব্যাপারেও যথাযথ সময়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। সবার উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা।” কোচবিহার সদর গর্ভমেন্ট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মলয়কান্তি রায় বলেন, “ নতুন বছরের শুরুতে বই , পোশাক দেওয়ার প্রস্তুতি কিন্তু শুরু হয়েছে। তার পর অন্তত পালা করে নবম-দ্বাদশ শ্রেণি থেকে ক্লাস শুরুর চেষ্টা হতে পারে। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে সংক্রমণের অবস্থা কোন দিকে যায়। সরকার ঠিক সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবে বলেই আমরা মনে করছি।” আলিপুরদুয়ারের বারোবিশা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নবনীতা সিকদার বলেন, “অতিমারির এই পরিস্থিতির সঙ্গে অন্য কোনও অবস্থাকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। রাজ্য সরকার এই পরিস্থিতিতে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সঠিক। অনলাইনে পড়াশোনা হচ্ছে। স্কুল খোলার ব্যাপারেও সঠিক সময়েই সিদ্ধান্ত হবে।”
অভিভাবক মহলের একাংশে অবশ্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলার দাবি উঠতে শুরু করেছে। কোচবিহার স্কুল অভিভাবক সমিতির তরফে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সমিতির সম্পাদক নেপাল মিত্র বলেন, “দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম অনেকের নেই। এই অবস্থায় ক্লাসের মোট পড়ুয়াদের দুটি ভাগে ভাগ করে সপ্তাহে তিন দিন পালা করে নতুন বছরে ক্লাস শুরু করা দরকার। না হলে নবম-দ্বাদশের পড়ুয়াদের বিশেষভাবে ক্ষতির একটা আশঙ্কা থাকছে। সরকার সব দিক ভেবেচিন্তে কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেই অপেক্ষা করছি।” অন্য কয়েক জন অভিভাবকও আশাবাদী, বিশ পেরোলেই বিষ কেটে যাবে। নতুন বছরে একুশে আবার প্রাণোচ্ছ্বলতায় ভরবে শিক্ষাঙ্গন। নতুন বছর ফিরিয়ে আনুক সেই পুরনো ছবি, স্কুলের বেঞ্চগুলি ভরে যাক আগের মতো। স্কুলের ঘন্টির শব্দ ফিরুক, আগের মতো দুপুরে স্কুলের ডাইনিং রুমে ধোঁয়া উঠুক গরম ভাতের। স্কুলের ডাইনিং হলে বসে সবার সঙ্গে মিড ডে মিলের খাবারটাও তো কম আনন্দের নয় পড়ুয়াদের অনেকের কাছে। নাটাবাড়ি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রণজিৎ সেনের কথায়, “প্রতিমাসে সব সামগ্রী পড়ুয়াদের জন্য বিলি করা হচ্ছে। তবে স্কুলে সবার মাঝে প্রিয় পড়ুয়াদের খাওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা। তার অনুভূতিটাও অন্যরকম। করোনার জন্য যা আমিও মিস করছি। করোনার কালো মেঘ কাটিয়ে নতুন বছরে সেই ছবিটা ফেরার প্রত্যাশাও রয়েছে। স্বপ্নও দেখি। তবে বাস্তবতাকেও মেনে নিতে হবে। সঠিক সময়ের অপেক্ষাটা একটু ধৈর্য রেখেই করতে হবে। সরকার সঠিক সময়েই সিদ্ধান্ত নেবে।”