সাম্প্রতিক বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ডলার-বন্ড বিক্রি করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ধার নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, খবরে প্রকাশ, আরএসএস-এর স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ তার বিরোধিতা করেছে, এবং এই বিরোধিতারই জেরে অর্থসচিব সুভাষচন্দ্র গর্গকে অর্থ দফতর থেকে সরে যেতে হয়েছে। অবশ্য শুধু আরএসএস নয়, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একাধিক প্রাক্তন গভর্নর— রঘুরাম রাজন, সি রঙ্গরাজন, ওয়াই ভি রেড্ডি— সকলেই ডলার-বন্ড বিক্রি করে বিদেশি ঋণগ্রহণের বিপক্ষে। উল্টো দিকে, অর্থমন্ত্রী ছাড়াও অর্থ দফতরের উপদেষ্টা কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মণ্যন এবং দেশি-বিদেশি একাধিক দক্ষিণ-ঘেঁষা আর্থিক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এই মুহূর্তে বিদেশ থেকে ধার নিয়ে উন্নয়নের গতি বাড়ানো ভারতের পক্ষে বিশেষ লাভজনক।
উন্নয়নের গতি বাড়াতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। নতুন টাকা ছাপিয়ে কিংবা কর বসিয়ে এই অর্থের সংস্থান করা সম্ভব নয়। টাকা ছাপালে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, ফলে মানুষের উপর চাপ বাড়বে, আর কর বাড়লে তো তার চাপ সরাসরি মানুষের উপর গিয়ে পড়বে। একমাত্র উপায়, বাজার থেকে ধার করা। ধার করারও সমস্যা আছে। সরকার বড় আকারে ধার করলে বাজারে সুদের হার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এত দিন রুপি-বন্ড বাজারে ছেড়ে টাকার অঙ্কে ধার করে এসেছে ভারত সরকার। ডলার-বন্ড বিক্রি করে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা এই প্রথম। রুপি-বন্ড বিক্রি করে ঋণ নিলে সুদ-সহ ফেরতযোগ্য অর্থ শোধ দিতে হয় টাকায়। অপর পক্ষে, ডলার-বন্ড বিক্রি মানে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ডলার ধার নেওয়া এবং নির্দিষ্ট সময় পর সুদ-সহ সেই ডলার ফেরত দেওয়া। যাঁরা ডলার-বন্ডের পক্ষে সুপারিশ করছেন, তাঁরা বলছেন, রুপি-বন্ডের পরিবর্তে ডলার-বন্ড বাজারে ছেড়ে ধার নেওয়ার অন্তত দুটো সুবিধে আছে। প্রথমত, দেশের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার অনেক কম। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ধার করলে দেশে সুদের হার কম রাখা সম্ভব হবে।
বস্তুত, সুদের হার কম রাখার ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত উদ্গ্রীব। বলা হয়, সুদের হার কম থাকলে উদ্যোগপতিরা বেশি করে ধার নিয়ে বিনিয়োগ করবেন, ক্রেতারাও ধার নিয়ে বাড়ি-গাড়ি-ফ্রিজ-টিভি কিনবেন। ফলে দেশে একটা আর্থিক জোয়ার আসবে। এখন, দেশের বাজার থেকে সরকার যত ধার করবে, তত দেশের ঋণের বাজারে ঋণের চাহিদা বাড়বে, সুদের হার বাড়বে, ফলে ব্যাহত হবে বৃদ্ধি, উন্নয়ন। ডলার-বন্ডের সমর্থকরা বলবেন, সেই সমস্যা এড়ানোর জন্যই বিদেশি ঋণগ্রহণ দরকার। বিদেশি ঋণ নিলে দেশি সুদের ওপর চাপ পড়বে না।
এর উল্টো যুক্তিও আছে। বিদেশি ঋণের উপর সুদের হার কম হতে পারে, তবে এই ধরনের ঋণে টাকা-ডলার বিনিময়মূল্য বদলে যাওয়ার ঝুঁকি পুরো মাত্রায় বর্তমান। ধরা যাক, ডলার-বন্ড বিক্রি করে আমাদের সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দুই শতাংশ সুদে ঋণ নিল। কিন্তু ঋণ শোধের সময় দেখা গেল ইতিমধ্যে ডলারের নিরিখে টাকার দাম দশ শতাংশ পড়ে গিয়েছে। এর মানে, টাকার মূল্যে ঋণশোধের পরিমাণ দশ শতাংশ বেড়ে গেল, অর্থাৎ টাকার নিরিখে প্রকৃত সুদের হার গিয়ে দাঁড়াল বারো শতাংশ, যা দেশি সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি। ডলার-বন্ডের প্রবক্তারা বলবেন, এই অঘটনটা ঘটবে না যদি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হয়ে টাকা-ডলার বিনিময় মূল্যটা বেঁধে রাখতে পারে। যে হেতু এই বিনিময় মূল্য অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির হারের উপর, তাই মূল্যস্ফীতি বশে রাখতে পারলেই টাকার অবমূল্যায়ন অনেকটা ঠেকানো যাবে।
কিন্তু ডলার-বন্ড বিক্রি করে বিদেশ থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি আটকে রাখা যাবে কি? বিদেশ থেকে ঋণ নিলে দেশে সুদের হার কম থাকবে এটা ঠিক, সুদের হার কম থাকার কারণে মানুষ বেশি ঋণ নেবেন এটাও ধরে নেওয়া যাক ঘটল, কিন্তু ব্যাঙ্কের ঋণ বাড়লে নগদের জোগান বাড়বে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। লক্ষণীয় যে, যদি এ রকম না ঘটে, অর্থাৎ কম সুদের হারে মানুষ বেশি ঋণ না নেন, তা হলেও মূল্যস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা। সরকার ডলারে ধার নিয়ে তো আর ডলারে খরচ করবে না। সরকারকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে গিয়ে সেই ধার করা ডলারের বিনিময়ে টাকা নিতে হবে এবং রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে ছাপাতে হবে এই বাড়তি টাকা। ফলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ডলার ভাণ্ডারটি যেমন স্ফীত হবে, তেমনই দেশে নগদের জোগানও বাড়বে। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, বিদেশ থেকে ঋণ নিলে বিনিময় মূল্যের ঝুঁকিটা এড়ানো যাচ্ছে না।
অন্য একটা গভীরতর সমস্যা আছে। ধার নেওয়া ডলার, যেটি প্রাথমিক ভাবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে ঢুকল, সেটি ধার শোধ হওয়া অবধি সে ভাবেই থেকে যাবে, এমন মনে করার কোনও ভিত্তি নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, রফতানির তুলনায় আমদানির আধিক্যের কারণে চলতি খাতে ক্রমবর্ধমান ঘাটতি, অকস্মাৎ কোনও গোলমালের ফলে দেশি শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পাইকারি হারে নিষ্ক্রমণ— এই রকম নানা কারণে সেই ডলার খরচ হয়ে যেতে পারে। সেই রকম কিছু ঘটলে ঋণ শোধের সময় ডলার পাওয়া যাবে কোথা থেকে?
আসল কথাটা হল, যদি আমাদের ডলার উপার্জনের রাস্তাটা খুব পরিষ্কার থাকত, অর্থাৎ যদি আমরা আমাদের রফতানির উপর ভরসা করতে পারতাম, তা হলে বিদেশি ঋণ নেওয়াটা হঠকারিতা বলে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যেত না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, আমদানির তুলনায় রফতানি তেমন বাড়ছে না। অর্থাৎ ডলার আয়ের তুলনায় ডলার ব্যয় বেশি হচ্ছে। যে হেতু ডলারের ধার ডলারেই মেটাতে হবে এবং যে হেতু আমাদের ভবিষ্যৎ ডলার উপার্জন অনিশ্চিত, তাই বিদেশি ঋণ আপাতত না নেওয়াই ভাল। স্মরণ করা যেতে পারে, গত আশির দশকে মেক্সিকো সরকার তাদের ঋণশোধের অক্ষমতা ঘোষণা করার পর গোটা লাতিন আমেরিকায় ঋণসঙ্কট ছড়িয়ে পড়ে, যার জের পুরোপুরি কাটতে একটা দশক লেগে গিয়েছিল। ইতিহাসে সরকারি ঋণখেলাপের আরও অনেক ঘটনা আছে। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ গ্রিস। ঋণখেলাপি দেশগুলির তালিকায় ভারত নিশ্চয়ই তার নামটা ঢোকাতে চাইবে না।
তা হলে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে আসবে? আমাদের মতে, এই মুহূর্তে ঋণের জন্য দেশি বাজারের উপর নির্ভর করাই ভাল। এতে হয়তো সুদের হার কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তা নিয়ে অতিরিক্ত উৎকণ্ঠার কারণ দেখি না। বস্তুত, সুদের হার কম হলেই যে অর্থনীতিতে লেনদেনের জোয়ার আসবে, এমন নয়। বিনিয়োগ কলকারখানা-যন্ত্রপাতিতেই হোক বা বাড়ি-গাড়ির মতো স্থায়ী ভোগ্যপণ্যে, শুধুমাত্র সুদের হারের উপর বিনিয়োগকারীর সিদ্ধান্ত সামান্যই নির্ভর করে। সিদ্ধান্ত মূলত নির্ভর করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীর ধারণার উপর। যদি এক জন উদ্যোগপতি মনে করেন ভবিষ্যতে তাঁর পণ্যের চাহিদা নেই, তা হলে সুদ যতই কম হোক তিনি কিছুতেই বিনিয়োগ করবেন না। ক্রেতা যদি মনে করেন ভবিষ্যতে তাঁর আয়ের স্থিরতা নেই, তা হলে শূন্য সুদে ধার পেলেও তিনি ভোগ্যপণ্য কিনবেন না, বরং ভবিষ্যৎ দুর্দিনের জন্য টাকা জমিয়ে রাখবেন। ত্রিশের দশকের মহামন্দা থেকে শুরু করে ২০০৭ সালের সাব প্রাইম ক্রাইসিস, সব ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে।
তা হলে সরকার সুদের হার কম রাখার চেষ্টা করছে কেন? কারণটা অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক। সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বাড়ে কি না আমরা ঠিক জানি না, কিন্তু নিশ্চিত ভাবে জানি সুদের হার কমলে উদ্যোগপতিদের মুনাফা বাড়ে। তাই উদ্যোগপতিরা সুদের হার কম রাখার জন্য সরকারের উপর সর্বদাই চাপ সৃষ্টি করেন। যে হেতু এই উদ্যোগপতিরাই অনেকাংশে বিজেপির নির্বাচনের খরচ বহন করেছেন এবং আশা করা যায় ভবিষ্যতেও করবেন, তাই বিজেপি সরকার এঁদের কথা ফেলতে পারে না। অপর পক্ষে, স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ, সন্দেহ নেই, মূলত তাদের স্বদেশিয়ানার প্রেক্ষিত থেকেই বিদেশি ঋণের বিরোধিতা করছে। মনে হচ্ছে, শেষ অবধি তাদেরই জয় হবে।
কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এ অর্থনীতির শিক্ষক