Visva-Bharati

একটি পাঁচিলের জন্য

যাঁহারা পাঁচিল দিতেছিলেন, আর যাঁহারা পাঁচিল ভাঙিতেছিলেন, মীমাংসা বা দ্বিপাক্ষিক বিবেচনার ইচ্ছা কোনও পক্ষেই ছিল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২০ ০০:০৪
Share:

সাধারণ বিদ্যালয়ের শুষ্ক প্রাণহীন সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রের মধ্যে সুকুমার শিশুরা যে দুঃখ পায়, তাহা হইতে তাহাদিগকে ‘মুক্ত করিবার জন্য’ রবীন্দ্রনাথ যখন ‘বোলপুরের নিকট বিশাল নির্জন প্রান্তরে’ শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়-আশ্রম তৈরি করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, তাঁহার মনোমাঝে প্রাচীরের কোনও কল্পনা ছিল কি না, এবং থাকিলে তাহা আজ আদৌ বিচার্য বলিয়া গণ্য হইবে কি না, প্রশ্ন উঠিতে পারে। পুরাতন যে ভাবনা একটি বিশ্ববিদ্যালয় বিংশ শতকে বহুলাংশে রক্ষা করিয়া আসিয়াছে, একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে আসিয়া তাহাকে আর দিগ্‌দর্শন হিসাবে মানিবার প্রয়োজন আছে কি না, প্রশ্ন উঠিতে পারে সেই বিষয়েও। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের একটি বিশেষ মাঠে প্রাচীর দেওয়া হইবে কি হইবে না, তাহাকে কেন্দ্র করিয়া যখন এহেন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়া যায়, পক্ষে বিপক্ষে রাজনীতির উন্মাদনা ভিড় জমাইয়া আসে, তখন একটি প্রশ্নের উত্তর বোঝা অতিশয় সহজ হইয়া পড়ে। তাহা হইল— যাঁহারা পাঁচিল দিতেছিলেন, আর যাঁহারা পাঁচিল ভাঙিতেছিলেন, মীমাংসা বা দ্বিপাক্ষিক বিবেচনার ইচ্ছা কোনও পক্ষেই ছিল না।

Advertisement

সেই ইচ্ছা ছিল না বলিয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহির হইতে লোকজন ভিড় করিয়া ধ্বংসযজ্ঞ সারিতে ধাইয়া আসে, প্রাঙ্গণের যে নিরাপত্তা লইয়া সাম্প্রতিক কালে বারংবার প্রশ্ন উঠিয়াছে, অশান্তি ও অস্থিরতার যে সব কারণ ঘটিয়াছে, তাহাকে আরও কয়েক ধাপ উদ্বেগজনক করিয়া দিতে পারে। অপর পক্ষে, মীমাংসার সদিচ্ছা থাকিলে প্রশাসন এতখানি বিক্ষোভ ও অমতের আঁচ পাইয়াও নিজের পথে ও মতে অটল থাকিবার জেদ প্রকাশ করিত কি না, সেই সংশয়ও অস্বাভাবিক নয়। দৃশ্যত, কোনও রকম প্রত্যক্ষ হেতু ছাড়াই বিষয়টি সংঘর্ষ ও হিংসার একটি দৃষ্টান্তে পর্যবসিত হইয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব এলাকায় পাঁচিল তুলিবার আইনি অধিকার কর্তৃপক্ষের আছে, তাহা অনস্বীকার্য, চাহিলে তাঁহারা সেখানে সর্বত্র অগণিত পাঁচিল তুলিতে পারেন, আইনে আটকাইবে না। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান বলিয়া দেয় যে, কেবল পাঁচিল তৈরিই প্রশাসনের এক্তিয়ারে পড়ে না, পাঁচিল বিষয়ক মতভেদ মেটানোও একটি প্রশাসনিক কাজই বটে। কিন্তু সেই কাজে তাঁহাদের তাগিদ এবং সামর্থ্য, দুইয়ের অভাবই অত্যন্ত প্রকট। আশঙ্কার বিলক্ষণ হেতু রহিয়াছে যে, বিবদমান দুই পক্ষের নিকটেই পৌষমেলার মাঠের পাঁচিল প্রকৃতপ্রস্তাবে একটি উপলক্ষ মাত্র। লক্ষ্য হইল পশ্চিমবঙ্গকে একটি রণক্ষেত্রে পরিণত করা, যে রণ শেষ পর্যন্ত রাজনীতির নিজস্ব হিসাবে একটি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করিবে। বিশ্বভারতীর গত সপ্তাহের হিংসাকাণ্ডের মূল মর্ম বোধহয় ইহাই।

এই পরিস্থিতিতে একটি পক্ষের জন্য সমবেদনা অনুভব না করিয়া উপায় থাকে না। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা বহু দিন হইতেই নানা রকম চাপের মধ্যে অতিষ্ঠ। বিবিধ প্রকার স্বার্থের মাঝখানে পড়িয়া তাঁহারা ক্রমাগত পিষ্ট হইতেছেন। ছোটখাটো বিষয়েও অকস্মাৎ তাঁহারা নিজেদের খুঁজিয়া পাইতেছেন গভীর সঙ্কটের মধ্যে। বিশ্বভারতী একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাহার আচার্য। পশ্চিমবঙ্গের এই একটি ‘দ্বীপ’ প্রত্যক্ষ ভাবে তাঁহার প্রশাসনিক আওতায় পড়ে। সুতরাং রাজায় রাজায় যুদ্ধ হইলে শান্তিনিকেতনবাসীর প্রাণ যায়। উৎপাতের নূতন পর্ব দেখিয়া বুঝিতে কষ্ট হয় না, আগামী কয়েক মাস, কিংবা হয়তো আরও অনেক দিন— অন্তত ২০২১-এর নির্বাচনী মরসুম অবধি— তাঁহারা কোন অপার শান্তির মধ্যে বাঁচিবেন, কী ভাবে বাঁচিবেন। চতুর্দিকে পাঁচিল তুলিলেই তাঁহাদের বসবাস নিরাপদ হইবে কি না, তাহা হয়তো বিশ্বভারতীর প্রাজ্ঞ কর্তারাই ভাল বলিতে পারিবেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement