উত্তরকাশীতে একটি প্রাইমারি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির চিফ অপারেটিং অফিসার, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এস গিরধর। সেখানে প্রধান শিক্ষকের টেবিলে একটা পাখির বাসা রাখা দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। প্রধান শিক্ষক সুরবীর সিংহ খারোলা জানান, ওটা ছাত্রছাত্রীদের একটা প্রজেক্ট-ওয়ার্কের নমুনা। স্কুল চত্বরের গাছে একটি পাখিকে বাসা বাঁধতে দেখে তিনি ছাত্রছাত্রীদের বাসাটির উপর নজর রাখার এবং প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে নোট করে রাখার ‘কাজ’ দেন। শর্ত ছিল, বাসাটিকে ছোঁয়া বা পাখিদের বিরক্ত করা যাবে না। প্রবল উৎসাহে ওরা সেই প্রজেক্ট সুসম্পন্ন করেছে এবং এমন অনেক কিছু জানতে পেরেছে, যা কোনও পরিবেশ-পরিচিতির বই তাদের শেখাতে পারত না।
মনে পড়ে যাচ্ছিল সুন্দরবনের একটি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কথা। এক সকালে তাঁর স্কুলে পৌঁছে দেখেছিলাম, আগের রাতের কালবৈশাখী ঝড়ে বাগানের লেবুগাছের ডাল থেকে খসে পড়েছে একটা বুলবুলির বাসা। আর ছোট্ট তিনটে ছানাকে দু’হাতের আঁজলায় ভরে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে প্রধান শিক্ষক। দু’টি দামাল ছাত্র তখন গাছে চড়ে বাসাটিকে পুনঃস্থাপনের কাজে ব্যস্ত। দৃশ্যটা দেখে, কেন জানি না, চোখে জল এসেছিল। উত্তরাখণ্ডেরই রুদ্রপুরের আর একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এস গিরধরকে যথার্থই বলেছিলেন, “এক জন সহৃদয়, দায়িত্ববান বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতা-সম্পন্ন ভাল মানুষ হতে না পারলে লিখতে, পড়তে, গুণতে বা যোগ করতে শিখে কোনও লাভ নেই।”
লকডাউনে স্কুল বন্ধ। পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষকদের অরাজনৈতিক সংগঠন ‘শিক্ষা-আলোচনা’-র সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার মধ্যেই অনেকে শুরু করেছেন নানা কাজ। যেমন, ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী করে ছোট ছোট নাটিকা লিখেছেন স্বরূপনগরের বাংলানি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তিলক মুখোপাধ্যায়। স্থানীয় নাটকের দলের ছেলেরা, যারা অনেকেই তিলকবাবুর প্রাক্তন ছাত্র, তারাও তখন কর্মহীন। তাদের দিয়ে বাচ্চাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন তিলকবাবু। তার পর গ্রামের বিভিন্ন খোলা জায়গায়, যতটা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব রেখে সেই নাটিকাগুলো মঞ্চস্থ করা হয় (সঙ্গের ছবি)। শুধু তা-ই নয়, সেগুলি নিয়মিত ইউটিউবে আপলোডও হতে থাকে। হাসতে হাসতে বলছিলেন তিলকবাবু, “সিলেবাসের খবর জানি না, কিন্তু শিক্ষাদানের কথা যদি বলেন, লকডাউনে সে কাজ এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।”
দক্ষিণ দিনাজপুরের কৈনালা মহাগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাজেদার রহমান লকডাউনের মধ্যেও প্রতি দিন স্কুলে গিয়েছেন এবং তাঁর তিন কিলোমিটার দূরের বাড়িতে ফিরেছেন রাত দশটার পর। স্কুলের নানা কাজের পাশাপাশি কিচেন গার্ডেন, মরসুমি ফুল-ফলের বাগান দেখাশোনা করার কাজে দিনটা কেটে যায় তাঁর। সন্ধের পর তিনি মোটরবাইক ভটভটিয়ে ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে হাজির হন। হাঁক দিয়ে জানতে চান, তারা পড়াশোনা করছে কি না। মসজিদের নমাজঘরে, শীতলামন্দিরের চাতালে— যেখানে সম্ভব সেখানে পড়াতে বসে যাচ্ছেন তিনি। ব্যাগে একটা ছাপানো ব্যানার ভাঁজ করে রাখা থাকে। তাতে লেখা ‘ভ্রাম্যমাণ পাঠশালা’।
পশ্চিম মেদিনীপুরের সঞ্জয় সামন্ত অথবা মুর্শিদাবাদের অম্বুজাপদ রাহা পুরনো শিক্ষক। স্থানীয় যে সব ছেলেমেয়ে বাচ্চাদের প্রাইভেট টিউশন পড়ায়, সকলেই তাঁদের প্রাক্তন ছাত্র। স্কুলে ডেকে পাঠিয়ে তাদের পাঠ্যক্রম, শিক্ষণ-কৌশল, মূল্যায়ন-পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে কয়েক দিন ধরে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার পর তাদের মারফত ছেলেমেয়েদের নানা রকম মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক করানোর কাজ চালিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। রাজস্থানের টঙ্ক জেলার একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক কমলচাঁদ মালিও একই সুরে এস গিরধরকে বলেছিলেন, “ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হওয়া বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করার সময় প্রতি বারই আমার মনে হয় যে, দশ জনের মধ্যে জনাছয়েক হয়তো কষ্টেসৃষ্টে স্নাতক স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে। কিন্তু প্রতি বারই ওরা যখন ক্লাস ফাইভে পৌঁছয়, তখন আমি নিশ্চিত হয়ে যাই যে দশ জনই স্নাতক স্তর পার হয়ে যাবে।” এই দূরদৃষ্টি, এই আত্মবিশ্বাসেরই অপর নাম শিক্ষকতা।
উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুর ব্লকের এক দল প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক এক অভিনব উদ্যোগ করেছেন— ‘ইনসে মিলিয়ে’। এস গিরধর-এর অর্ডিনারি পিপল একস্ট্রা অর্ডিনারি টিচার্স
(আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটি) থেকে জানতে পারি, কিছু দিন অন্তর একটা সভার আয়োজন করেন তাঁরা। শিক্ষকতার কাজে তুলনামূলক বেশি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, এমন শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা এবং কর্মপদ্ধতি বাকিদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ডাকেন। এস গিরধর এঁদের বলেছেন, ‘দ্য হিরোজ় অব রিয়েল ইন্ডিয়া’। এই ‘নায়ক’-দের সঙ্গে দেশবাসীর, বিশেষত শিক্ষকসমাজের অবশিষ্টাংশের পরিচয় হওয়া জরুরি। তা হলে হয়তো অলস, ফাঁকিবাজ, দায়িত্বজ্ঞানহীন অপবাদগুলি থেকে তাঁদের মুক্তিলাভ ঘটলেও ঘটতে পারে।