ধর্মতলায় এই মিছিল থেকেই ওঠে ‘গোলি মারো গদ্দারোঁ কো’ স্লোগান। —নিজস্ব চিত্র।
নগর পুড়িলে দেবালয় অক্ষত থাকে না। সুতরাং দেশের বিশ্বাসঘাতকদের গুলি মারিবার পবিত্র কীর্তন কলিকাতার রাজপথে গীত হইয়াছে, ইহাতে বিস্ময়ের কোনও কারণ নাই। কলিকাতাকে দেবালয় মনে করা কতটা সঙ্গত তাহা লইয়াও সংশয় আছে, কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর যাহাই হউক, একটি কথা রবিবারের বারবেলায় নূতন করিয়া স্পষ্ট হইয়া উঠিল। সংক্ষেপে বলিলে সত্যটি ইহাই যে, হিংসাত্মক স্লোগান আকাশ হইতে পড়ে না, তাহার পিছনে থাকে রাজনীতির প্রশ্রয়, রাজনীতির নেতাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব। সেই প্রভাব ও প্রশ্রয় হিংস্রতার পরিবেশ রচনা করিয়া দেয়, অনুকূল পরিবেশে বিষবৃক্ষ উচ্চফলনশীল হয়। এই সত্যের প্রকাশ গত কয়েক বছরে বারংবার, বস্তুত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে, দেখা গিয়াছে। হিংস্র আচরণ এবং হিংসাত্মক প্রচার, কোনওটিই এই দেশে নূতন নহে, কিন্তু নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার পারিষদবর্গ দিল্লির মসনদে বসিবার পর হইতে সেই গোত্রের প্রচার এবং আচরণ যে ব্যাপক ও গভীর আকার ধারণ করিয়াছে তাহা সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব।
হিংস্রতার এই বিস্ফোরণের পিছনে ক্ষমতাসীন নায়কনায়িকাদের ভূমিকা কোথায় পৌঁছাইতে পারে, তাহার অগণিত নজির ভারতবাসী ইতিমধ্যে দেখিয়াছে। তাঁহারা অনেকেই সরাসরি হিংসার বাণী প্রচার করিয়াছেন, অনেকে আবার নিজমুখে সেই বাণী উচ্চারণ না করিয়াও কাজ সারিতে সক্ষম হইয়াছেন— অনুরাগ ঠাকুর মুখে ‘গোলি মারো’ বলেন নাই, তাঁহার শ্রোতারা তাঁহার ‘দেশ কে গদ্দারোঁ কো...’ উচ্চারণের পাদপূরণ করিয়াছেন। (মন্ত্রিবর এখন সেই না-বলা-বাণীর দোহাই পাড়িয়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ আনিতেছেন!) অমিত শাহের কৌশল-জ্ঞান চাণক্যের এক শতাংশও না হইতে পারে, কিন্তু তাহা অনুরাগ ঠাকুর অপেক্ষা স্বভাবতই উন্নততর। শহিদ মিনারের সভায় তিনি দিল্লির নাম উচ্চারণ করেন নাই, করিবার কথাও নহে— গায়ে পড়িয়া আপন অপদার্থতা (এবং অন্যান্য অপরাধ) স্বীকার করিবার অভ্যাস এই শাসকদের কস্মিনকালেও তিলমাত্র নাই। মার্চ মাসের প্রথম দিবসে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কার্যত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার শুরু করিয়া দিয়াছেন, তাঁহাদের ভোটপ্রচারের বক্তব্য, ভাষা এবং ভঙ্গি যেমনটি হইয়া থাকে, এই বক্তৃতায় তেমনটিই উদ্ভাসিত। ‘ভূমিপুত্র’কে মুখ্যমন্ত্রী করিবার নিতান্ত নিচু দরের লোভ দেখাইয়াছেন, ‘সোনার বাংলা’ গড়িবার ততোধিক ছেঁদো স্বপ্নও দেখাইতে ভুলেন নাই। কিন্তু সরাসরি হিংসার আহ্বান তাঁহার প্রকাশ্য ভাষণে শোনা যায় নাই।
তাহার প্রয়োজনও ছিল না। সেই ভাষণ প্রচারিত হইয়াছে রাজপথে, অমিত শাহের সভায় যোগ দিতে আসা অনুরাগীদের শ্রীমুখে। তাহারা পদতলে মেদিনী প্রকম্পিত করিতে করিতে গগনভেদী বার্তা দিয়াছে: গোলি মারো ইত্যাদি। বিজেপির স্থানীয় নায়কেরা কেহ কেহ এই গোলন্দাজ বাহিনী হইতে নিজেদের তফাতে রাখিতে চাহিয়াছেন, তাঁহাদের লজ্জাবোধের কয়েক রতি হয়তো এখনও অবশিষ্ট আছে। তবে দলের রাজ্য সভাপতি সাফ জানাইয়া দিয়াছেন, কাহারা ওই স্লোগান দিয়াছে তিনি জানেন না, কিন্তু ইহাতে তাঁহার ‘বিরোধিতা নাই’। কেন বিরোধিতা নাই, সেই যুক্তিও তাঁহার বয়ানে প্রাঞ্জল: দেশের সম্পত্তি যাহারা নষ্ট করে তাহাদের গুলি করাই উচিত। যোগী আদিত্যনাথের আক্ষরিক প্রতিধ্বনি। আগামী এক বছরে, অনুমান করা চলে, এই প্রতিধ্বনি প্রবলতর হইবে। ভোট আসিতেছে। শাহজি বলিয়া গিয়াছেন, তিনি নিয়মিত পশ্চিমবঙ্গে আসিবেন, নিয়মিত বাস করিবেন। আরও অনেক গোলন্দাজ বাহিনীর হামলার জন্য রাজ্যবাসীকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। রাজ্য বিজেপির ভক্তমহলে কোনও সাহিত্যরসিক থাকিলে বলিতে পারিতেন: সুপবন বহিতেছে, পতাকা উড়াইয়া দাও, তাহাতে লিখো— গোলি মারো সালোঁ কো।