ত্রাসের দেশ

অন্যান্য রাজ্যের প্রশাসকরা যখন দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে গ্রস্ত, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যখন বিজয় রূপাণীর কাছে নিজের রাজ্যের মানুষদের নিরাপত্তা লইয়া চিন্তাপ্রকাশে ব্যস্ত, উত্তরপ্রদেশের আদিত্যনাথ তাহারই মধ্যে বৃহত্তর রাজনীতির চালটি চালিয়া রাখিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০০:২০
Share:

যোগী আদিত্যনাথ বিজয় রূপাণীকে টেলিফোনে জানাইয়াছেন, তাঁহার কোনও সংশয় নাই যে বাহির হইতে গুজরাতে কাজ করিতে আসা শ্রমিকদের সেই রাজ্যের প্রশাসন যথোচিত দেখভাল করিয়াছে, এবং যথেষ্ট সুরক্ষা দিয়াছে। অশান্তি-সংঘর্ষ যতই হউক, গুজরাত যে একটি আদর্শ রাজ্য ও তাহার অর্থনীতি সমাজ দুই-ই যে অবশিষ্ট দেশের আদর্শস্বরূপ, তাহা বলিয়া উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করিয়াছেন। এই আশ্বাসের দরকার ছিল বইকি। গত কয়েক দিন ধরিয়া রূপাণীর রাজ্য যে ভয়ঙ্কর দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখিল, এবং বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ হইতে সেই রাজ্যে আসা অভিবাসী কর্মীসম্প্রদায় সেখানে যে বিরাট ত্রাসের সম্মুখীন হইলেন, তাহাতে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর স্বস্তিভঙ্গের কারণ ছিলই। হাজার হাজার লোক নিজের রাজ্যের ট্রেন বাস গাড়ি ধরিতে বাহির হইয়া পড়িয়াছেন, যদিও তাঁহারা ভালই জানেন, ফিরিয়া আসিলে তাঁহাদের জীবিকানির্বাহের কোনও আশু ব্যবস্থা হইবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমত পরিস্থিতিতে, অন্যান্য রাজ্যের প্রশাসকরা যখন দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে গ্রস্ত, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যখন বিজয় রূপাণীর কাছে নিজের রাজ্যের মানুষদের নিরাপত্তা লইয়া চিন্তাপ্রকাশে ব্যস্ত, উত্তরপ্রদেশের আদিত্যনাথ তাহারই মধ্যে বৃহত্তর রাজনীতির চালটি চালিয়া রাখিলেন। বিজেপির তীর্থ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসককে তুষ্ট করিয়া রাখাই বিধেয় বলিয়া বিবেচনা করিলেন। ক্ষুদ্রের মধ্যে হারাইয়া না গিয়া বৃহৎ লক্ষ্যটি দেখিতে পারা রাজনীতিকের গুণ। আদিত্যনাথ প্রমাণ করিলেন, তিনি নীতীশ কুমারদের অপেক্ষা বড় রাজনীতিক।

Advertisement

রূপাণীর সঙ্কটটি গুরুতর। এক দিকে তাঁহাকে নিজের রাজ্যের ক্রুদ্ধ জনসাধারণকে সামলাইতে হইতেছে। জনৈক অভিবাসী শ্রমিক দ্বারা একটি স্থানীয় শিশুর ধর্ষণকে কেন্দ্র করিয়া রাজ্য জুড়িয়া— বিশেষত উত্তর গুজরাতে যে প্রবল ক্রোধের বিস্ফোরণ, তাহার সমালোচনা করিলে তিনি নিজের রাজ্যেই প্রান্তিক হইয়া পড়িবেন। অন্য দিকে, বেশি উত্তেজনা দেখাইলে প্রবাসী শ্রমিকরা বিপন্নতর বা ক্ষুব্ধতর হইতে পারে, তাই সেই পথেও তিনি হাঁটিতে পারিতেছেন না। তিনি ও তাঁহার সহকর্মীরা ভালই জানেন যে, তথাকথিত ‘গুজরাত মডেল’ বলিয়া যাহার দেশবিদেশে খ্যাতি, ইতিহাসে যাহার অমর স্থান, ভারতশাসনের পথে যাহা বিজেপির গরিমার প্রধান ভর, সেই মডেলের কেন্দ্রীয় স্থলে রহিয়াছেন এই অভিবাসী শ্রমিক সম্প্রদায়। তাঁহারা রাগ করিলে কিংবা নিরাপত্তার অভাবে রাজ্য ত্যাগ করিলে গুজরাতের ঘোর অমঙ্গল। এই সঙ্কট রাজ্যের উত্তর দিকে বেশি, কেননা সেখানে উন্নয়নের সূচকগুলি তুলনামূলক ভাবে দুর্বল ও অর্থ রোজগারের হার তুলনায় কম, তাই রাজ্যের অধিবাসীরা সেই দিকে পা বাড়াইতে চাহেন না, অভিবাসীদের দিয়াই সেখানকার শিল্পকারখানা ও অন্যান্য পরিকাঠামোর কাজ চালাইতে হয়।

রূপাণীর অপেক্ষাও যদি কেহ গুজরাতের সাম্প্রতিক সঙ্কটে চিন্তিত হইয়া থাকেন, তবে তাঁহাদের নাম নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন প্রায় আসিয়া পড়িয়াছে, এমন মাহেন্দ্রমুহূর্তে হঠাৎ যদি বিজেপির মডেল রাজ্য গুজরাত হইতে ভিন্ন রাজ্যের শ্রমিকদের এই ভাবে উৎখাত হইতে হয়, তাহা সুলক্ষণ বলা চলে না। রাজ্য-স্তরের বিজেপি নেতারা নিশ্চয়ই এত দিনে দলের ‘সুপ্রিমো’দের মূল কথাটি বুঝাইতে পারিয়াছেন: রাজ্যে অর্থনৈতিক সুযোগ কমিয়া আসিবার ফলেই এত রকমের হিংসাত্মক সঙ্কট। এক দিকে পতিদার আন্দোলন, অন্য দিকে অভিবাসী শ্রমিকবিরোধী আন্দোলন, সব মিলাইয়া গুজরাত এখন কণ্টকশয্যায়। অমিত শাহরা শান্তিতে নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement