Uttar Pradesh

ন্যক্কারজনক

‘লাভ জেহাদ’ নিবারণী আইনের একটি মৌলিক অবস্থান হইল, নারী মানেই সম্পত্তি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

যাহা ছিল রাজনৈতিক কার্যক্রম, যোগী আদিত্যনাথ তাহার উপর রাষ্ট্রীয় সিলমোহর লাগাইবার ব্যবস্থা পাকা করিলেন। মন্ত্রিসভা অনুমতি দিল, কোনও মহিলাকে কেবলমাত্র ধর্মান্তরকরণ করিবার উদ্দেশ্য লইয়া ভিন্‌ধর্মের বিবাহ সংঘটিত হইলে— গৈরিক পরিভাষায় যাহার নাম ‘লাভ জেহাদ’— তাহাতে দণ্ডবিধানের ব্যবস্থা করিতে অধ্যাদেশ জারি করা হইবে। প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর স্বেচ্ছায় জীবনসঙ্গী বাছিবার অধিকারকে খর্ব করিবার উদ্দেশ্যে অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্তটি ভয়াবহ, কিন্তু তাহাকে যদি সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হয়, তবে ভয়াবহতার স্বরূপটি সম্পূর্ণ উন্মোচিত হইবে। বোঝা প্রয়োজন যে, এই সিদ্ধান্তটি প্রক্ষিপ্ত নহে, কোনও এক ক্ষমতা-উন্মাদের বিকৃত আস্ফালনও নহে— ইহা ভারতের গৈরিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ছকে বাঁধা একটি পদক্ষেপ। যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন সরকার এবং সার্বিক ভাবে বিজেপি দীর্ঘ দিন ধরিয়া ‘লাভ জেহাদ’-এর রাজনীতি করিতেছে। ব্যক্তিপরিসরকে ধর্মীয় রাজনীতির আখড়া বানাইবার অভ্যাসটি তাহাদের সদ্য-লব্ধ নহে। মানুষকে ধর্মীয় পরিচিতির দ্বারা চিহ্নিত করিবার অনুশীলন তাহাদের মজ্জাগত। তদুপরি, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিতর সংখ্যালঘুর দ্বারা লাঞ্ছিত হইবার ভীতি তৈরি করিয়া রাখাও সঙ্ঘ-রাজনীতির বহুপ্রাচীন কৌশল। ‘লাভ জেহাদ’-এর ধারণাটি এই কৌশলের প্রকট অঙ্গ। রাষ্ট্রক্ষমতা মিলিলে সেই বিষের রাজনীতিতে নখর-দন্ত যোগ হইবে, তাহাতে বিস্ময়ের কারণ নাই।

Advertisement

‘লাভ জেহাদ’ নিবারণী আইনের একটি মৌলিক অবস্থান হইল, নারী মানেই সম্পত্তি। কেহ— এই ক্ষেত্রে কোনও বিধর্মী পুরুষ— সেই সম্পত্তি দখল করিতে চাহিলে রাষ্ট্র তাহাতে বাধা দেওয়ার ব্যবস্থা করিবে। ইহাই কি মনুবাদী সমাজের মূলগত দর্শন নহে? তাহার সহিত আধুনিক রাষ্ট্রভাবনার পার্থক্য ও সংঘাত কোথায়, ইলাহাবাদ হাই কোর্টের একটি সাম্প্রতিক রায়ে তাহার দিকনির্দেশ আছে। আদালত জানাইয়াছে, আইনের দৃষ্টিতে দুই নারী-পুরুষ শুধু ধর্মের সদস্য নহেন, তাঁহারা ‘স্বাধীন ইচ্ছা’র অধিকারী ব্যক্তিদ্বয়। অর্থাৎ, আধুনিক রাষ্ট্র যে শুধু দুই প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীকে স্বেচ্ছায়, স্বাধীন ভাবে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অনতিক্রম্য অধিকার দেয় তাহাই নহে; সেই অধিকার লিঙ্গনিরপেক্ষ— অর্থাৎ, আধুনিক রাষ্ট্রদর্শন কোনও অবস্থাতেই নারীর ‘এজেন্সি’ অস্বীকার করে না। দিল্লি হাই কোর্টও একটি মামলায় জানাইয়াছে, কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার স্বেচ্ছায় যে কোনও স্থানে এবং যে কারও সহিত বাস করিবার স্বাধীনতা আছে। তিনি যদি স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ এবং বিবাহ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে তাঁহার মতামতকে সম্মান জানানো এবং তাঁহাকে নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশের কর্তব্য।

যোগী আদিত্যনাথদের আইন প্রণয়নের চেষ্টা যে শুধু সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে, তাহা নহে— একই সঙ্গে ইহা আধুনিক, উদারবাদী রাষ্ট্রভাবনার বিরুদ্ধেও জেহাদ। গৈরিক জাতীয়তাবাদ নাগরিকের জীবনের প্রতিটি পরিসর নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহে— ধর্মীয় পরিচিতির মাধ্যমে, পুরুষতন্ত্রের যুক্তিতে। সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্বের ধারাবাহিকতায় যেমন, যোগী-রাজ্যের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেও ‘লাভ জেহাদ’ নিবারণী অধ্যাদেশকে তেমন ভাবে দেখিলে ইহার রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটটি স্পষ্ট হইবে। সংখ্যালঘু-নিগ্রহের ঘটনায় উত্তরপ্রদেশ দেশে অগ্রগণ্য; মহিলাদের উপর নির্যাতনের ঘটনাতে দেশে সর্বোচ্চ স্থানে। তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের উপর অত্যাচারেও উত্তরপ্রদেশই এক নম্বর। হিন্দু-উচ্চবর্ণ-পুরুষতন্ত্রের এই সহিংস আধিপত্য যে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় ব্যতীত অসম্ভব, তাহা বলা নিষ্প্রয়োজন। সেই রাজ্য অধ্যাদেশ জারি করিয়া প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণের চেষ্টা করিলে তাহাকে ক্ষমতা-উন্মাদের আস্ফালন হিসাবে না দেখিয়া মনুবাদী প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসাবে দেখাই বিধেয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement