পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে স্টোনওয়াল হোটেলে হাঙ্গামা ও ধরপাকড়ের জন্য সম্প্রতি ক্ষমা চাহিয়াছে মার্কিন পুলিশ। সেই হোটেলে তখন বহু বিখ্যাত সমকামী দম্পতির যাতায়াত ছিল। মার্কিন পুলিশের তাহা পছন্দ হয় নাই। অতএব চণ্ডনীতি। কালক্রমে সমাজ ও নৈতিকতা বদলাইয়াছে, এলজিবিটিকিউ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার ও কুয়র) বর্গের মানুষ আর পাঁচ জনের সমান অধিকার পাইয়াছে। মূলধারার অ-সমকামী নারী-পুরুষ যৌনতার বয়ানটি যে সব নহে— পৃথিবী স্বীকার করিয়া লইয়াছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশে পুলিশের ক্ষমা প্রার্থনায় সেই সত্যেরই উদ্ভাস।
বঙ্গসমাজে স্টোনওয়াল আজ সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু অতীতে এমনটি কেহ ভাবিতেও পারিত না। তাহার নৈতিকতায় উদার দৃষ্টির ভূমিকা ছিল প্রবল। যথা, বাংলার নানা গ্রামে ঘেঁটুপূজার আধিক্য ছিল। বালক নারীবেশে গান গাহিত। বালক সুন্দর হইলে জমিদার তাহাকে বাহিরবাটীতে পোষণ করিতেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের খাকি উর্দি দূর অস্ত্, ব্রিটিশ শাসনে লালপাগড়ি পরিহিত পুলিশও এই প্রথায় হস্তক্ষেপ করে নাই। নদীমাতৃক এই দেশের কোন অখ্যাত গ্রামে কোন বালক নারীবেশে ঘেঁটু কিংবা শীতলার পালা গাহিতেছে, তাহা লইয়া রাষ্ট্রশক্তি মাথা ঘামায় নাই। বীরভূমের ভাদুপূজায় একদা সুন্দর কোনও বালক ভদ্রেশ্বরী বা ভাদু সাজিত, তাহার সঙ্গীরা ‘হেলেদুলে খেল করিস কদমতলে’ বলিয়া গান গাহিত। নারীবেশী বালককে শ্রীরাধিকার ন্যায় কদম্বতরুমূলে খেলিবার পরামর্শ! লোকধর্মের এই সহিষ্ণুতাই বাংলার চালিকাশক্তি। সাহিত্যও এই সব ‘মেয়েলি পুরুষ’দের বর্জন করে নাই, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের নসুমামা পুরুষ হইয়াও শাড়ি পরেন, রান্না করিতে ভালবাসেন। কয়েক বৎসর পূর্বেও বাংলাদেশের লেখক হুমায়ুন আহমেদ ঘেঁটুপূজায় বালক ও প্রবীণ জমিদারের সম্পর্ক লইয়া ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ নামে একটি উপন্যাস লিখিয়াছিলেন। এই লোকধর্মগুলি দুই বাংলার ঐতিহ্য। এই পারে হিন্দু, ওই পারে মুসলমান বলিয়া জাতীয় নাগরিকপঞ্জির কাঁচি চালাইয়া এই ঐতিহ্য ধ্বংস করা যাইবে না। হিন্দু জমিদারের ঘেঁটু বা ভাদুর ন্যায় মুর্শিদাবাদের আলকাপ গানেও কি থাকিত না ‘ছোকরা’ গায়কের চাহিদা? সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের উপন্যাসে তাহার বিবরণ আছে।
ইহাই বাংলার সংস্কৃতি। কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুই রানির মিলনে ভগীরথের জন্ম। পুণ্যসলিলা গঙ্গার মর্তে আগমনের পশ্চাতেও বিকল্প যৌনতার একটি বয়ান ভাবিয়াছিল বাঙালি। অতএব, বৃহৎ ধর্মের বাহিরে, লোকধর্মের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বয়ানগুলি আজ আবার ঝালাইবার সময় আসিয়াছে। বাঙালি রামনবমী, হনুমান পূজা করে না আর সেখানেই উত্তরাপথের সহিত তাহার তফাত— এই ধরনের চিন্তার গর্ভে বড় জোর প্রাদেশিকতা জন্ম লইতে পারে, তাহার বেশি নহে। বাঙালির নিজস্ব ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ জানায়, বাল্মীকি স্বয়ং ব্যাসদেবকে মহাভারত ও পুরাণ শিখাইয়াছিলেন। মূলধারার বাহিরে গিয়া বাঙালি বাল্মীকি ও ব্যাসকে একত্র জুড়িয়াছে। মূলধারার যৌনতার বাহিরে গিয়া সে যে লোকধর্মে অন্য একটি অন্তঃসলিলা বয়ান তৈরি করিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী! স্টোনওয়াল হাঙ্গামার পঞ্চাশ বৎসরে লোকধর্মের এই স্মৃতিগুলিই হউক স্মার্ত বাঙালির মুখ্য অভিজ্ঞান।