স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াইবার জন্য যাঁহারা অনবরত গলা ফাটাইতেছেন, সেই টাকার কতটা অপব্যবহার হইতেছে সে বিষয়ে তাঁহারা নীরব। অথচ প্রাণ বাঁচাইতে হইলে ঔষধ লেখা কমাইতে হইবে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঔষধের অপপ্রয়োগ লইয়া সতর্ক করিয়াছে। গুজরাতের হাসপাতালে ঔষধ লেখায় ভ্রান্তির অনুপাত ছত্রিশ শতাংশ, কেরলে এগারো শতাংশ। ইহা কেবল রোগীর প্রাণসংশয়ের উপক্রম করে না, দেশের অর্থনীতির উপর এক বিপুল বোঝা চাপাইয়া দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্লান্তি, প্রেসক্রিপশনের দুর্বোধ্যতা, রোগীদের প্রতি ভুল নির্দেশ, এমন নানা কারণে ভ্রান্তি ঘটিতেছে। ভারতে ইহার সহিত যোগ করিতে হইবে অযৌক্তিক চিকিৎসার সমস্যা। যেখানে ঔষধের প্রয়োজন নাই, সেখানেও ডাক্তার তাহা লিখিতেছেন। চিকিৎসকের অভাবে অ-চিকিৎসক কিংবা ঔষধ-বিক্রেতার চিকিৎসাবৃত্তি, চিকিৎসকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের অভাব, ঔষধ ব্যবসায়ীদের উৎকোচ দানের অভ্যাস, সরকারের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা, এমন নানা বিষয় মিলিয়া এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি হইয়াছে। ইহার কোনও একটিকে নিয়ন্ত্রণ করিলে লাভ হইবে না, প্রত্যেকটি সমস্যাকে করিতে হইবে। তাহা এক দীর্ঘমেয়াদি, পর্বতপ্রমাণ কাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই কাজটি করিতেই বলিতেছে। চিকিৎসক, বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, রোগীদের প্রতিনিধি এবং সমাজের নানা দিক হইতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের লইয়া একটি সামগ্রিক নীতি প্রণয়ন করিবার উপর তাঁহারা জোর দিতেছেন।
ভারতের সংবিধান অনুসারে স্বাস্থ্য বিষয়টি রাজ্যের তালিকাভুক্ত। ঔষধের অপব্যবহার রুখিতে রাজ্যকেই অগ্রণী হইতে হইবে। কোনও উদ্যোগ যে তাহারা লয় নাই, এমন নহে। রাজস্থানে সকল সরকারি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ‘আপলোড’ হইয়া যায়। ইহাতে কোন ঔষধের কেমন ব্যবহার হইতেছে, সে বিষয়ে সরকার নজর রাখিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ ডিগ্রিহীন ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ চলিতেছে, যাহার অন্যতম উদ্দেশ্য অকারণ ঔষধের ব্যবহার বন্ধ করা। সেই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালে কিছু নির্দিষ্ট ঔষধ বিনা পয়সায় মিলিতেছে। ইহাতে রোগীর অকারণ ঔষধ কিনিবার ঝোঁকও কমিবার সম্ভাবনা। সমস্যা ইহাই যে, সরকারি চিকিৎসায় কিছু নজরদারি সম্ভব হইলেও বেসরকারি ক্ষেত্রে তাহার সুযোগ নাই বলিলেই চলে। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কিছু নির্দিষ্ট ঔষধ কেবল মাত্র প্রেসক্রিপশনের ভিত্তিতে বিক্রয় করিবার, এবং তাহার তথ্য রাখিবার নির্দেশ দিয়াছিল ঔষধ বিক্রেতাদের। কিন্তু তাহার পর কোনও নজরদারি হয় নাই।
ঔষধের অতিরিক্ত বা ভ্রান্ত ব্যবহারের যে ফলগুলি তৎক্ষণাৎ সম্মুখে আসিতেছে, তাহার পশ্চাতে রহিয়া যাইতেছে আরও ভয়ানক সম্ভাবনা। ঔষধের অকারণ এবং ভ্রান্ত ব্যবহারে, সেই সঙ্গে কৃষি ও প্রাণীপালনে অবাধ প্রয়োগের জন্য মানবশরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জন্মাইতেছে। ইহার ফলে অতি সাধারণ জীবাণুও মারাত্মক হইয়া উঠিতেছে। মশা মারিতে কামান দাগিবার মতো, সামান্য সংক্রমণের জন্য অতি-কড়া, অতি মূল্যবান ঔষধ আনিতে হইতেছে। ইহা বন্ধ করিবার নীতি গ্রহণ করিতে হইবে, প্রয়োগেও সতর্ক থাকা বিধেয়।