নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে যোগ দিয়ে আটক ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। ছবি: এএফপি
ভারত তাহার হৃদয়ের দ্বার খুলিল। দিল্লি হইতে বেঙ্গালুরু, কলিকাতা হইতে মুম্বই, দেশ জুড়িয়া পথে নামিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। পুলিশের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করিয়া, নির্যাতন ও হয়রানির সকল ঝুঁকি মাথায় লইয়া তাঁহারা ঘর ছাড়িয়া বাহিরে আসিলেন। বেঙ্গালুরুতে ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করিয়া আটক হইলেন অগণিত মানুষ, রামচন্দ্র গুহ-সহ। দিল্লিতে পুলিশি নিপীড়ন প্রতিবাদীদের আটকাইতে পারিল না। তনিকা সরকারকে পুলিশ আটক করিয়া দূরে লইয়া গিয়া ছাড়িয়া দিবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রতিবাদস্থলে ফিরিয়া আসিলেন। যোগেন্দ্র যাদব গ্রেফতার হইয়া টুইট করিলেন, ‘সম্মানিত হইলাম।’ কলিকাতায় নাগরিক মিছিল হইতে স্লোগান উঠিল, ‘গাঁধীওয়ালি আজাদি, নেহরুওয়ালি আজাদি, অম্বেডকরওয়ালি আজাদি।’ বার্তা স্পষ্ট। স্বাধীনতার আন্দোলন কেবল ব্রিটিশকে তাড়াইবার লড়াই ছিল না। নেতা ও অনুগামীরা ভারতের একটি ভাবমূর্তি গড়িয়াছিলেন। তাঁহারা ব্রিটিশের গুলি-লাঠি খাইয়াছেন, জেলে পচিয়াছেন, ফাঁসিতে ঝুলিয়াছেন, এবং স্বার্থ বিসর্জন দিয়া দেশগঠনের কাজ নীরবে করিয়াছেন, কারণ দেশের সেই ধারণা তাঁহাদের হৃদয়ে সেই শক্তি, সেই প্রেরণা সঞ্চার করিয়াছিল। সেই ভারত কি বৈষম্যদুষ্ট, আধিপত্যবাদী ‘হিন্দু ভারত’ হইতে পারে? এই দেশ সমস্বরে জবাব দিল: না। সেই জবাব ভরসা দিল: ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ কথাটি আজও জনজীবনের মন্ত্র। নাগরিকত্ব আইন ভারতকে সেই মন্ত্র হইতে বিচ্যুত করিতে চাহে। সেই অপমানে সারা দেশ উদ্বেল হইয়াছে। গুলবর্গা, শিলং, বিজাপুর, মথুরা, কানপুর, লখনউয়ের মতো শহরে অগণিত মানুষ পথে নামিয়া প্রতিবাদ করিতেছেন।
প্রতিবাদীরা কোনও বিশেষ সুবিধা দাবি করেন নাই, দাবি করিয়াছেন নাগরিকের মর্যাদা। ব্রিটিশ রাজত্বে পুলিশের হাতে মৃত্যুর আশঙ্কায় মানুষ পকেটের চিরকুটে নাম-ঠিকানা লিখিয়া মিছিলে যাইতেন— সেই ইতিহাস মনে করাইল ১৯ ডিসেম্বর। ইহা কেবল আবেগের কথা নহে। সকল ধর্ম, সকল শ্রেণি, সকল লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষ যে ভাবে নাগরিকত্বের প্রশ্নে পাশাপাশি আসিয়া দাঁড়াইলেন, তাহা সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি একটি বার্তা। বার্তাটি ইহাই যে, বৈষম্য-প্রসূত ক্ষোভকে রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহারের বিষয়ে তাঁহাদের সতর্ক হইতে হইবে। জাতি-সম্প্রদায় ভিত্তিক রাজনীতি এই দেশে কম হয় নাই। কিন্তু তাহার প্রকৃত লক্ষ্য আর্থ-সামাজিক সাম্য, তথা রাষ্ট্রক্ষমতায় সকল জাতি-ধর্মের ভারসাম্য। হিন্দুত্ববাদীরা যে রাষ্ট্র নির্মাণ করিতে ব্যগ্র, তাহাতে বৈষম্যের উৎস বিদ্বেষ, তাহার লক্ষ্য একটি জাতির আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। নাগরিকত্ব আইন বাতিলের দাবি তুলিয়া অগণিত ভারতবাসী সেই লক্ষ্যকে বর্জন করিলেন।
যাঁহারা পথে নামিলেন, তাঁহাদের একটি বড় অংশ ছাত্র, বয়সে তরুণ। দেনাপাওনার ছক কষিয়া রাজনীতি করিতে ছাত্রেরা অভ্যস্ত নহে। ভয় আর প্রলোভন, নেতাদের হাতে জনতাকে নিয়ন্ত্রণের এই দুইটি অস্ত্র হার মানিয়া যায় তরুণদের নিকট। দিল্লি পুলিশের লাঠি-বন্দুকের সম্মুখে জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন অকুতোভয় তরুণীর প্রতিরোধ যুবাসম্প্রদায়কে ঘা দিয়া জাগাইয়াছে। তাঁহারা বুঝিয়াছেন, এই ভয়-কুণ্ঠিত, সন্দেহাচ্ছন্ন, বিভেদকামী রাষ্ট্র তাঁহাদের উত্তরাধিকার নহে। স্ব-দেশ দাবি করিয়া তাঁহারা পথে নামিয়াছেন। তাঁহাদের নাগরিকত্বের পরীক্ষা করিবে কে? এই দিন নিঃসংশয়ে জানা গেল, গণতান্ত্রিক বহুত্বের আদর্শ প্রজন্ম হইতে প্রজন্মে সঞ্চারিত হইয়াছে। গণতন্ত্রের আত্মরক্ষার লড়াই এখনও বিস্তর বাকি। কঠিন লড়াই। কিন্তু দেশব্যাপী প্রতিবাদে নবীন প্রজন্মের প্রবল, সরব, সতেজ ভূমিকাটি ভরসা দেয়: সব শেষ হয় নাই। আশা জাগায়: অবসানের সূচনা হইতেছে। ভয়ের অবসান। ভারত তাহার রুদ্ধকণ্ঠের দ্বার খুলিতেছে।