গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
শাঁখের করাত। কোন দিকে নয়, রাত পোহালেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের বাজেট কতটা কাটবে সেটাই এখন প্রশ্ন। গত কয়েক দশকে কোনও অর্থমন্ত্রীকেই এত সমস্যার নিরসনের প্রচেষ্টা এক বাজেটে করতে হয়নি! মন্দা না মন্দা নয়, এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, আমরা সাধারণ নাগরিক জানি আমাদের কী অবস্থা।
ঘরের ছেলের চাকরি নেই। চাকরি থাকলেও তা কত দিন থাকবে তা জানা নেই। চিকিৎসার খরচ বাড়ছে। তাল মিলিয়ে কমছে অবসরের পরের আয়। হাসপাতাল গেলে বেঁচে ফিরলেও, খরচ মিটিয়ে রান্নাঘরের আঁচ দেওয়ার টাকাটাও যেন বাড়ন্ত হয়ে উঠছে। তবে আঁচ তো প্রায় নিভু নিভু। কারণ, যে হারে গ্যাস ও আনাজের দাম বেড়েছে তাতে পয়সা বাঁচাতে অতি অনাচারীও সপ্তাহে একাধিক দিন নিরম্বু উপবাসের কথা ভাবছেন হয়ত। দেড়শো টাকায় পেঁয়াজ কিনতে চোখের জল মোছার কাপড় এমনিতেই বাড়ন্ত। দেখা যাক তথ্য কী বলছে।
গত এগারো বছরে বৃদ্ধির হার এ বার সবথেকে কম। পাঁচ শতাংশের হিসাব নিয়ে আমরা চলছি। কোনও কোনও গবেষণায় তা দেখাচ্ছে পাঁচেরও নীচে। গত ৪৫ বছরে বেকারির হারের এই বেহাল অবস্থা হয়নি। সরকারি তথ্যেই বলছে ৬ শতাংশ। গত সাত বছরে বাজারে ব্যক্তিগত খরচের বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন। দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫.৮ শতাংশে। বিনিয়োগের বৃদ্ধির হারও গত ১৭ বছরে সর্বনিম্ন— কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ শতাংশে। কৃষির অবস্থাও তথৈবচ। বৃদ্ধির হার কমে ২.৮ শতাংশে, গত চার বছরে সর্বনিম্ন। গত চল্লিশ বছরে এই প্রথম দেশে দারিদ্র বৃদ্ধির হারও বাড়তে শুরু করেছে। ক্ষেতমজুরদের আয়ও কমছে সাংঘাতিক হারে। রাজকোষ ঘাটতিও ঊর্ধমুখী।
ছবি: পিটিআই।
এমতাবস্তায় কী করণীয়! বিশেষজ্ঞরাও কিন্তু আতান্তরে। তাঁরাও হাতড়ে চলেছেন উপায়। কিন্তু সবাই মনে করছেন যে, বাজারে চাহিদা বাড়াতে হবে। তা বাড়াতে গেলে তো ক্রেতাকে বাজারে ফিরতে হবে। কিন্তু ক্রেতারা সে রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন না।
এখানে একটা অনিশ্চয়তার বোঝা কিন্তু প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগকারী থেকে ক্রেতা সবাই ‘কাল কী হবে কে জানে’ এই বোধের জায়গা থেকে খরচ করার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। আয়ও তো কমছে সাধারণ মানুষের। আগে যে কাজ করলে ১০০ টাকা পাওয়া যেত, এখন তা কমে হয়ত ৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার হালও তথৈবচ।
এমতাবস্তায় উপায় একটাই। বাজারে সবথেকে বড় ক্রেতা সরকার। সরকার যদি পরিকাঠামোয় খরচ করতে শুরু করে, তা হলে লগ্নি বাড়বে, পণ্যের চাহিদা বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে, মানুষের হাতে টাকা আসবে, আরও চাহিদা বাড়বে, সেই চাহিদা মেটাতে হবে বেসরকারি লগ্নি। বৃদ্ধির এই শৃঙ্খলই নাকি এখন আশা বাজারের।
অর্থাৎ, সরকারকে খরচ বাড়াতে হবে। আর এই খানেই আর এক সমস্যা অর্থমন্ত্রীর সামনে। কোষাগারের হাল খারাপ। টাকা তো লাগবে খরচ করতে। এখন যদি নোট ছাপিয়ে খরচ মেটাতে হয়, তা হলে জিনিসের দাম বাড়বে। ইতিমধ্যেই খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭.৩৫ শতাংশে। আরও বাড়লে তো সমস্যা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে।
উপায় তা হলে আরও কর চাপানো। কিন্তু সেখানেও তো সমস্যা। লোকে এমনিতেই নাকি খরচ করতে চাইছে না নীতি অনিশ্চয়তায়। তার উপর করযোগ্য আয়ের উপর আরও কর চাপালে, লোকের হাতে তো খরচের টাকা আরও কমে যাবে। ১৯৭১ সালে সর্বোচ্চ আয়কর ছিল ৯৩.৫ শতাংশ। একশ টাকা আয় করলে লোকের হাতে আসত সাড়ে ছয় টাকা। তার পর থেকে কমতে থাকে। ১৯৯২ সালে মনমোহন সিংহের হাতে তা কমে দাঁড়ায় ৪৪.৮ শতাংশে। তার পর থেকে তা ক্রমাগত কমে দাঁড়িয়েছিল ৩০ শতাংশে। গত বছর তা এক ধাক্কায় বেড়ে দাঁড়ায় ৪২.৭ শতাংশে— নানান সেস ও সারচার্জ নিয়ে! আয় বাড়াতে সরকার কি আবার আয়কর বাড়াবে?
আরও পড়ুন: ভাইরাস হানার ধাক্কা ভারতের পর্যটন শিল্পে
বাজারে বেহাল অবস্থা বলে নাকি জিএসটি আদায়ের হালও তথৈবচ। জিএসটি অবশ্য বাজেটে বাড়ে না। বাড়ে জিএসটি কাউন্সিলের মিটিংয়ে। তাই বাজেটে এই সংক্রান্ত আদায় জনিত কী হিসাব দেখান হয়, সেটাও কিন্তু একটা কৌতুহলের বিষয়। কারণ, চারিদিকে একটা সমালোচনা চলছে বাজেটে স্বচ্ছতা নিয়ে। কর্পোরেট কর থেকে বাকি প্রায় একগাদা কর বিষয়ক সিদ্ধান্ত কিন্তু বাজেট এড়িয়েই করেছেন অর্থমন্ত্রী। তাই বাজারে চাহিদা বাড়াতে আসলে কোন রাস্তায় হাঁটবেন অর্থমন্ত্রী, তা হয়ত বাজেটে স্পষ্ট নাও হতে পারে।
এরই সঙ্গে রয়েছে রাজ্যগুলির প্রাপ্য করের ভাগ মেটাতে দেরি হওয়া। যাঁরা মাস মাইনের কারবারি তাঁরা জানেন— মাইনে পেতে দেরি হলে আসলে কিন্তু খরচ বেড়ে যায়। কারণ, পরের মাসের মাইনে পেতে দেরি হলে, অনেককেই প্রতিশ্রুত খরচ মেটাতে ঋণের রাস্তায় হাঁটতে হয়। আর তাতে কিন্তু সুদ, তা যত কমই হোক— যেমন ক্রেডিট কার্ডে— দিতে হয়ই। রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও কিন্তু একই কথা প্রযোজ্য। দেরিতে টাকা আসা মানে হয় প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যায়, না হলে ধার করে তা করতে হয়। রাজ্যের তাতে কিন্তু খরচ বাড়ে, বাড়ে ঋণও। আরও একটা কথা। প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেলে কিন্তু সেই প্রকল্পের কাজে যাঁরা নিযুক্ত তাঁরাও কিন্তু আয় অনিশ্চয়তার শিকার হন। আর এই অনিশ্চয়তার কারণেই মানুষ যতটা পারে খরচ কমিয়ে টাকা হাতে রাখার চেষ্টা করে, আগামীতে দেরিতে আয়ের টাকা ঘরে এলে যাতে সেই কদিন চালিয়ে নেওয়া যায় তা দেখতে।
আরও পড়ুন: কর দিয়েও সুরক্ষার দাবি করতে পারব না কেন?
শাঁখের করাত তো বটেই। গত বছর সরকার যে বৃদ্ধির আশায় কর থেকে আয়ের অঙ্ক কষেছিল, সেই বৃদ্ধি আকাশকুসুম থেকে গিয়েছে। এ বছরও ছয় শতাংশের আশেপাশে বৃদ্ধির হার ধরেই সরকার নিশ্চয় বাজেটের অঙ্ক কষবে। হয়ত এ বার কর ছাড়ও মিলবে করযোগ্য আয়ের উপর। লোকের অন্তত আশা তাই। কিন্তু টাকার ব্যবস্থা করতে এক দিকে ছাড় দিলে, অন্য দিকে কোপ তো পড়বেই! তাই শাঁখের করাতের টান এই করনীতিতে কোন দিকে চলে তাই দেখার। দেখার, মানুষকে বাজারে ফেরাতে অর্থমন্ত্রী কী টোপ ফেলেন!