—ফাইল চিত্র।
বিক্ষুব্ধ কৃষকদের অবরোধ কোনও এক দিন শেষ হইবে। হয়তো বা সর্বোচ্চ আদালতের পরামর্শ মানিয়া আপাতত কৃষি আইনের প্রয়োগ স্থগিত থাকিবে, সুপ্রিম কোর্ট প্রদত্ত কমিটি নামক সর্বরোগহর বটিকায় সরকারের দুশ্চিন্তা এখনকার মতো দূর হইবে। হয়তো বা শেষ অবধি সরকারের জেদই জয়ী হইবে, অপূর্ণ থাকিয়া যাইবে কৃষকদের দাবি। কিন্তু সে সকলই ভবিষ্যতের কথা। ইতিমধ্যে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ঘটিয়াই গিয়াছে। কাহারও কোনও প্রতিবাদ শুনিব না, কেহ বেসুর গাহিলেই তাহাকে দেশদ্রোহী বলিয়া দাগাইয়া দিব, যে কোনও বিক্ষোভ দমনে রাষ্ট্রশক্তির যথেচ্ছ দাপট চালাইব— গত ছয় বছর ধরিয়া অনুসৃত এই রীতিই শাসকরা প্রথম পর্বে কৃষকদের উপরেও প্রয়োগ করিতে চাহিয়াছিলেন। সেই অস্ত্র বুমেরাং হইবার পরে ‘আলোচনা’র প্রদর্শনী শুরু করেন, কিন্তু তাহাও দ্রুত তাঁহাদের দিশাহীন অসহায়তার করুণ প্রদর্শনীতে পর্যবসিত হয়। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের যৌথ পরাক্রম হয়তো আরও বিস্তর কীর্তি স্থাপন করিবে, কিন্তু কৃষক আন্দোলনের মোকাবিলায় তাঁহারা সম্পূর্ণ বেকুব বনিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা ‘ম্যাক্সিমাম গভর্নমেন্ট’ তৈয়ারি করিতে পারেন, ‘মিনিমাম গভর্ন্যান্স’ সরবরাহ করিতে পারেন না।
না পারিবার প্রথম কারণ অজ্ঞতা। এই সরকারের চালকরা বহু বিষয়েই অজ্ঞ, তবে যে বিষয়টিতে তাঁহাদের বোধ ও ধারণা কার্যত শূন্য, তাহার নাম অর্থনীতি। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো তাঁহারা বিশেষ বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর মুখ চাহিয়া বা তাহাদের নির্দেশ মানিয়া পদক্ষেপ করেন, কিন্তু বৃহত্তর অর্থনীতির পক্ষে তাহার পরিণাম ভয়ঙ্কর হইয়া উঠে, যে পরিণাম পূর্বাহ্ণে অনুমানের কোনও ক্ষমতাই শাসকদের নাই, সংশ্লিষ্ট আমলা বা উপদেষ্টারাও হয়
তাঁহাদের তালে তাল দিয়া চলেন অথবা তাঁহাদের পরামর্শ আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। নোটবন্দি হইতে অতিমারিজনিত সঙ্কটের মোকাবিলা অবধি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইহার বিস্তর নজির দেশবাসী দেখিয়াছেন। কৃষি নীতির ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। সংসদে জবরদস্তি করিয়া কৃষি আইন পাশ করাইবার পিছনে বিশেষ স্বার্থের ছায়া ঘনঘোর, তাহাকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’ নামে অভিহিত করা হউক বা না হউক। অথচ প্রয়োজনীয় বিবেচনাবোধ থাকিলে বা তাহা কাজে লাগাইলে শাসকরা অনুমান করিতে পারিতেন, তাহার কী বিপুল প্রতিক্রিয়া ঘটিতে পারে।
অজ্ঞতার নিরাময় সম্ভব, কিন্তু তাহার সহিত পর্বতপ্রমাণ অহঙ্কার যুক্ত হইলে ব্যাধি দুরারোগ্য হয়। কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সেই ঐতিহ্য সমানে চলিতেছে। অন্তত বিক্ষোভ দানা বাঁধিবার আগে তাঁহারা ক্ষুব্ধ কৃষকদের সহিত আন্তরিক ভাবে কথা বলিয়া একটি মীমাংসা-সূত্র বাহির করিতে পারিতেন, তাহার বিলক্ষণ সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সব জানেন, তিনি যখন এক বার বলিয়া দিয়াছেন এই আইনগুলি ভাল, তাহার উপর আর কথা চলিতে পারে না। অতএব সরকার বলিল: আলোচনা, প্রতিধ্বনি আসিল: শুধু মিছে কথা, ছলনা। অধুনা শ্রীমোদী ইতস্তত কেবলই বলিতেছেন, দুষ্ট বিরোধীরা কৃষকদের ভুল বুঝাইতেছেন, তাই এই গোলযোগ। তাঁহার বিচারে কৃষকরা নাবালকপ্রতিম কি না, সেই প্রশ্ন থাকুক। কিন্তু কৃষকদের ‘ঠিক’ বুঝাইতে তাঁহাকে কে বারণ করিয়াছে? মাস ঘুরিতে চলিল, কৃষকদের সম্মুখে এক বার তাঁহার সশরীর আবির্ভাব ঘটিল না কেন? যে কোনও বিষয়ে প্রকৃত বা কল্পিত সাফল্যের জন্য কৃতিত্ব দাবি করিতে যে নায়করা সতত অগ্রণী, এমন একটি সঙ্কটের দায় তাঁহারা স্বীকার করিবেন না কেন? ছলে, বলে অথবা কৌশলে শেষ অবধি হয়তো কার্যসিদ্ধি হইবে, কিন্তু অজ্ঞতা এবং অহঙ্কারের সমাহারের এই লজ্জাকর ইতিহাস মুছিবার নহে।