হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হার্ভার্ড স্কোয়ার ‘টি’ স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলেন এক দিনমজুর। এক হাতে দুপুরের খাবারের বাক্স, অন্য হাতে ঝোলা। বসেই, ঝোলা থেকে বার করলেন একটা বই। ওখানে অনেকেই তা-ই করেন, বলতে কী, বেশির ভাগই। আপিস-টাইমে খুব ভিড় হলে আলাদা কথা, এমনিতে লোকে খামকা সময় নষ্ট না করে কিছু না কিছু পড়ে। সুতরাং মজুরটি যে বই বার করলেন, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু অবাক করল বইয়ের শিরোনাম: ক্যাপিটাল, লেখক কার্ল মার্ক্স। যেচে আলাপ করে জানলাম, একটু আগেই কিনেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বইয়ের দোকানগুলোতে মার্ক্সের জীবনী ও রচনার বিপুল সম্ভার। বাঙালি মধ্যবিত্তের অপ-চেতনায় সে সম্ভার শ্রমিকশ্রেণির বোঝার জন্য নয়, সে সব কঠিন তত্ত্বের ব্যাপার, বিদ্যাবেত্তাদের আলোচনার বিষয়। মজুরটি চমকে দিলেন, ‘‘এ বই তো আমাদের জন্যই লেখা, আমরা যারা সারা দিন পরিশ্রম করি, অথচ দিনের শেষে অনেকের ফিরবার মতো একটা ঘর পর্যন্ত নেই, রাস্তায় থাকতে হয়, তাদের নিয়েই তো এই বই।’’ গন্তব্য কুইন্সি স্টেশন ৪৫ মিনিটের পথ, মজুরটি যাবেন আরও দূরে। অনর্গল বাক্যালাপ। “শুধু আমাদের জন্য নয়, এ বই সবার জন্য। এই তো দেখো না, ২০০৮-এর যে আর্থিক সঙ্কটে আমেরিকা জেরবার, সে বিষয়ে পণ্ডিতরা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পেরেছিল? কিন্তু মার্ক্স পেরেছিলেন। যত মুনাফা বাড়বে, ততই মানুষের দুর্দশা বাড়বে, মানুষ যদি ভাল না থাকে তা হলে বাজার ধসে পড়বে।’’ বস্তুত, সঙ্কটের আগে-পরের গতিপ্রকৃতির অনুধাবন তো ঠিক এই কথাটাই বলে। সঙ্কুচিত ক্রয়ক্ষমতা কৃত্রিম উপায়ে বাড়ানো হল ঋণের বিস্ফারিত বাজার দিয়ে। পরিণতি সবার জানা।
এর থেকে বেরোনোর উপায়? মার্ক্সের উত্তর: বিপর্যয়ের পিছনে যে সব কারণ কাজ করছে তাদের প্রকৃতি অনুসন্ধান। সেই অনুসন্ধান বলে, দুনিয়াটাকে এমন ভাবে বদলে ফেলতে হবে, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার ইচ্ছা মতো বাঁচতে পারবে, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে, প্রয়োজন অনুযায়ী সামাজিক উৎপন্ন গ্রহণ করবে। সে বড় কঠিন কাজ। অতএব বিদ্যমান ব্যবস্থার ‘উকিলরা বিপর্যয়ের অস্তিত্বটাই অস্বীকার করে। বিপর্যয়গুলো বারংবার দেখা দেওয়া সত্ত্বেও তারা বলে যায়, অর্থশাস্ত্রের পাঠ্যবইতে যে ভাবে লেখা আছে সে ভাবেই যদি পণ্য উৎপাদন জারি রাখা যায়, তবে কখনওই সঙ্কট আসবে না।’
ভাবের ঘরে চুরিটা প্রমাণিত— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী অন্তত সাত বার নানা রকম মন্দার ভিতর দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ বারের সঙ্কট এত ভয়ানক যে, বিশ্ব পুঁজিবাদের মস্তিষ্ক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পর্যন্ত তাদের জন্মজাত শত্রুর বিশ্লেষণ থেকে খানিকটা ধার না নিয়ে পারেনি: “মার্কিন অর্থব্যবস্থা সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার মধ্যে কিছু মার্ক্স-বর্ণিত ধারা উঠে আসছে। কর্পোরেট মুনাফা সাঙ্ঘাতিক ভাবে বেড়ে চলেছে; দেশে বিপুল বেকারত্ব, তাকে দূর করার ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর কোনও হেলদোল নেই; অথচ ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের সুবাদে তাদের বৃদ্ধি অব্যাহত।” পৃথিবীজোড়া পুঁজিবাদী পুনরুত্থান, এবং সমাজবাদের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট ও বাহ্যিক বিপর্যয়ের সুযোগে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার পাহারাদাররা যে কার্ল মার্ক্সকে অচল, অপ্রাসঙ্গিক বলে ঠেলে দিয়েছিল জমাট বিস্মরণে, ২০০৮-এর সঙ্কটের কালে তাদের কোনও না কোনও ভাবে তাঁকেই আবাহন করতে হল। তাঁর রচনাগুলো বিপুল সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত এবং পঠিত হতে লাগল। এক অর্থশাস্ত্রীর কথায়, “মার্ক্সের কাছে ফেরাটা এ কারণে নয় যে, তাঁর মতবাদ অখণ্ডনীয়, বরং এই কারণে যে তিনি অপরিহার্য।’’
তিনি নিজে কোথাও দাবি করেননি যে, তাঁর মতবাদ অখণ্ডনীয়। তাঁর ব্যবহৃত পদ্ধতিটাই সে দাবির অনুমোদন দেয় না। মানুষের পূর্ণতম আত্মবিকাশ ও তার সামাজিক অস্তিত্ব— দুইয়ের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর আজীবন অনুসন্ধানের ভিত্তিই ছিল এক প্রশ্নবাচী প্রক্রিয়া। পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বস্তুকে তার প্রকৃত অবস্থানে দেখা, বাইরের রূপকে অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা, খণ্ড থেকে সমগ্র ও সমগ্র থেকে খণ্ডে ফিরে আসা। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে পরিচিত এ পদ্ধতি কোনও কিছুকে শাশ্বত বলে মানে না। যাঁর প্রিয়তম নীতিবাক্য: ‘সব কিছুকে সংশয়ের চোখে দেখো’, তাঁর কাছে নিজের মতবাদও কি সংশয়ের ঊর্ধ্বে?
নয় বলেই, তিরিশ বছর ধরে নিয়ম করে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের একটা কোনায় বসে অধ্যয়নে ডুবে যাওয়া। যা দেখছেন, যা শুনছেন, যা উপলব্ধি করছেন সেগুলো প্রমাণের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া। যেখানে যে বিদ্যার প্রয়োজন তার যথাযথ ব্যবহার। হাতের লেখার ব্যাপারে যতটা কৃপণ— একটা পাতায় ৯০০ শব্দ আঁটাতেন— পড়ায় ততটাই গোগ্রাসী, দর্শন ইতিহাস অর্থশাস্ত্র গণিত জীববিজ্ঞান নৃতত্ত্ব, প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য, সংবাদ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদন, কিছুই বাদ পড়েনি পাঠ্যতালিকা থেকে। এবং যা পড়ছেন, পড়ে যা মনে হচ্ছে, সে সম্পর্কে হাজার হাজার পাতা লিখে যাওয়া। দারিদ্র এতই তীব্র যে কাগজ কেনার পয়সাটুকুও অনেক সময় থাকত না। দারিদ্র নিয়ে ক্ষোভের অবকাশ ছিল না, কারণ তাঁর মস্তিষ্কে অবিরাম আছড়ে পড়ত চিন্তার বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ। যে ব্যবস্থাটা অমানবিক, যা নীতিহীন, শোষণ যার ভিত্তি, মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার যার স্বাভাবিক জৈবক্রিয়া, সেই ব্যবস্থাটার বিরুদ্ধে ক্রোধে ফেটে পড়ছে তাঁর মস্তিষ্ক।
এই ক্রোধ থেকেই জন্ম নেয় প্রজ্ঞা— এক স্পষ্ট দৃষ্টি, যা অনাগত কালকে বহু দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। পুঁজির কেন্দ্রীভবন, একচেটিয়া মুনাফা, ব্যাপ্ত অসাম্য, মানুষের যন্ত্রে পরিণত হওয়ার মতো ভবিষ্যতের যে বর্ণনা মার্ক্সের রচনা থেকে লোকে পুনরুদ্ধার করছে, তা কোনও রাশিবিজ্ঞান-নির্ভর নির্ভুলতা নয়, তথ্য তাঁর কাছে সত্যে পৌঁছনোর একটা রাস্তা। তাঁর ক্রোধ ও প্রজ্ঞার উৎস হল সত্যানুসন্ধানের স্পষ্ট উদ্দেশ্য— কী কারণে সত্যকে খুঁজব? সেই উদ্দেশ্যের মূলে মানুষ, যে নিজেই নিজেকে পূর্ণতম করে তুলবে। উদ্দেশ্যের স্পষ্টতা থেকে গড়ে ওঠা ভবিষ্যদ্দৃষ্টি নিয়ে তিনি আমাদের এই দেশটাকেও দেখেছিলেন: “[ভারতীয়রা] মানুষকে উন্নীত করার বদলে নিজেদের... অপরিবর্তনীয় ভাগ্যের হাতে সঁপে, প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর পূজায় আত্মনিবেদন করে... আত্ম-অবনতির পরাকাষ্ঠা রূপে ভক্তিবিগলিত হয়ে তারা বানর, কানুমান [হনুমান] ও গাভী সব্বলা [কপিলা]-র পদতলে হাঁটু গেড়ে বসে।’’ কিংবা, “ভারত শুধু হিন্দু ও মুসলমানে বিভক্ত নয়; সেখানে জাতির সঙ্গে জাতির, জনজাতির সঙ্গে জনজাতির বিভাজন।”
১৮৫৩-র এই লেখার কিছু অংশের জন্য তিনি কম সমালোচিত হননি। বস্তুত, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর ভারত সম্পর্কে তাঁর মত অনেক ব্যাপারে বদলায়। যেমন ক্রমশ বদলেছিল রাশিয়া বা অন্য সমাজগুলো সম্পর্কে। সত্যানুসন্ধানের মানবকেন্দ্রিক উদ্দেশ্য তাঁর অধ্যয়নকে ব্যাপ্ততর করে তোলে, তিনি পাঠ নিতে থাকেন ইউরোপের বাইরের নানা সমাজের। শুধু পুঁজিবাদী কাঠামো নয়, পৃথিবীতে ক্ষমতার প্রকৃতি, শ্রেণিবিভাজনের ভিন্ন ভিন্ন স্বরূপ, মানুষের নানা চেহারা মিলে সেই পাঠ মানুষকে দিশা দেখিয়ে যাচ্ছে মানব-উত্তরণের পথে। তাঁর জীবন নিয়ে যে এত নতুন নতুন কাজ হচ্ছে, তাঁর মতের ঘোর বিরোধীরাও তাঁকে নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন, সেটা বর্তমান পুঁজিবাদী সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য নয়, বিশ্বজোড়া নৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তির খবর পাওয়ার জন্য।
না, ব্যাদে সব কিছু নেই। যেমন, তিনি প্রকৃতিকে জয় করবার কথা বলেছেন। অথচ আজকের দাবি প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চলা। যদিও তিনি লিখছেন উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, কিন্তু সেই আলোচনা এখনকার দিনে অপূর্ণ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। সমস্যার মূলগত চরিত্রের ব্যাপারে তাঁর বিশ্লেষণ নির্ভুল— অতি মুনাফার ঊর্ধ্বশ্বাস প্রতিযোগিতা। কিন্তু সব কিছু সম্পর্কে একেবারে ষোলো আনা খাঁটি বিশ্লেষণ তাঁর রচনায় পাওয়া যাবে, তিনি কিছুতেই এমন দাবি করবেন না। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের বিশেষজ্ঞ কার্ল মার্ক্স জানতেন আরিস্ততলের এই বক্তব্যটা: “যে কোনও ব্যাপারে অনুসন্ধান ততটুকুই যথাযথ হতে পারে যতটুকু তার বিষয়বস্তু করতে দেয়।’’ প্রয়োগের জন্য জ্ঞানের আহরণ, আবার প্রয়োগ থেকে শিক্ষা নিয়ে সে জ্ঞানকে পরিশুদ্ধ করে তোলা— এটা যেমন প্রজ্ঞার প্রকাশ, তেমনই জ্ঞানের সীমা সম্পর্কে কাণ্ডজ্ঞানও এক ধরনের প্রজ্ঞা, যা খুব কম লোকেরই থাকে। মার্ক্সের তা ছিল বলেই তাঁর সত্যানুসন্ধান এখনও এত প্রাসঙ্গিক, ব্যাকরণগত অভিধায় ঘটমান বর্তমান।