প্রতীকী ছবি।
একবিংশ শতকেও যে কোনও রাষ্ট্র এমন আইন করিতে পারে, তাহাই অবিশ্বাস্য। তুরস্কের এর্দোয়ান সরকার বিল আনিতেছে, আঠারো বৎসরের কম বয়সি মেয়েকে ধর্ষণে অভিযুক্ত পুরুষ মেয়েটিকে বিবাহ করিলে শাস্তি হইতে মুক্তি পাইবে। অর্থাৎ নিপীড়িতের সুবিচারের অধিকার ভিন্গ্রহের বিষয়, মানবাধিকার স্বপ্নমাত্র। একটি রাষ্ট্রের সরকার নিপীড়ককেই বাঁচাইবার তাল করিতেছে, ইহাই নিদারুণ বাস্তব। ধর্ষণের ন্যায় অপরাধের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতিশূন্য নীতি লইয়া যেখানে ধর্ষকের উপযুক্ত শাস্তিবিধান জরুরি ছিল, সেইখানে বিবাহকে ঢাল করিয়া, অত্যাচারী ও অত্যাচারিতকে মিলাইয়া দিয়া এক হাস্যকর বিচারের পথে অগ্রসর হইতেছে রাষ্ট্র। ধর্ষণের ন্যায় ঘটনায় যন্ত্রণার সহিত সমান ভাবে মিশিয়া থাকে লজ্জা ও সামাজিক অমর্যাদার বোধ। সেই লজ্জা ও অবমাননা হইতে বাঁচিবার জন্যই দেখা যায় অপরাধীর সহিত ধর্ষিতার বিবাহের বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা হইয়া থাকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়া যাওয়া, মরমে মরিয়া থাকা মেয়েটির পরিবারের দিক হইতেই। কিন্তু রাষ্ট্রের আইন-প্রণেতারাও যখন বিবাহকেই ধর্ষণের মতো অপরাধের মুশকিল আসান বলিয়া মনে করেন, তখন কেবল মানবাধিকার ও নারী অধিকার কর্মীদেরই নহে, নাগরিক মাত্রেরই ক্রুদ্ধ ও হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
শুভবোধসম্পন্ন যে কেহ বুঝিবেন, এই বিল আইন হইলে বস্তুত সিলমোহর পড়িবে বাল্য (বা নাবালিকা) বিবাহের উপরেই। কারণ বিলে উল্লিখিত ধর্ষিতারা এই ক্ষেত্রে নাবালিকা। একটি সুসভ্য ও সুসংস্কৃত রাষ্ট্র একই সঙ্গে বাল্যবিবাহেরও সমর্থক— এই অবস্থানই বুঝাইয়া দেয়, এই দুইটি জিনিস একসঙ্গে চলিতে পারে না। হয় উহা একবিংশ শতকে আসিয়াও সভ্যতা কী জিনিস বুঝে নাই, নতুবা তাহা নীতি ও মতাদর্শগত ভাবে নিতান্ত পশ্চাৎমুখী, আরও স্পষ্ট করিয়া বলিলে— ফ্যাসিবাদী। তাহা কেবল উদগ্র পুরুষতান্ত্রিকতাতেই থামিয়া থাকে না, নিতান্ত নাবালিকাকেও পুরুষের ভোগ্যবস্তু বানাইয়া প্রকৃতপক্ষে শিশু নির্যাতন ও যৌন শোষণের পথ সুপ্রশস্ত করিয়া তুলে। বিশ্বের ইতিহাস সাক্ষী, একনায়কতন্ত্র সর্বদা, সর্বত্র নারীর অধিকারকে তাহার নিশানা বানাইয়াছে। আবারও সেই বিল ফিরাইয়া আনিয়া এর্দোয়ান সরকার সদর্পে স্বরূপ চিনাইতেছে। ২০১৬ সালেও তুরস্কে এই বিল আনিবার প্রস্তুতি নিয়াছিল সরকার, দেশের সীমানা ছাড়াইয়া সারা বিশ্বে প্রবল প্রতিবাদের মুখে তাহা বাতিল হয়।
চার বৎসর আগে ভারতে মাদ্রাজ হাই কোর্টের এক রায়কে বাতিল করিয়া সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানাইয়া দিয়াছিল, সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া ব্যতীত ধর্ষক ও ধর্ষিতার ভিতর কোনও রূপ ‘মধ্যস্থতা’র প্রশ্নই উঠিতে পারে না। সেইখানেও দুই পক্ষের মিটমাট হিসাবে নিম্ন আদালতে আনা হইয়াছিল বিবাহের প্রসঙ্গ। ভারতে ধর্ষণ আদৌ বিরল তো নহেই বরং নিয়মিত, ন্যায়বিচারও বহু ক্ষেত্রেই সুদূরপরাহত। কিন্তু ধর্ষককেই বিবাহ করিয়া লওয়ার মতো নিদানকে এখনও সংবিধানসিদ্ধ করিয়া তুলিবার চেষ্টা এই দেশে হয় নাই, ইহাই বাঁচোয়া। প্রকৃত গণতন্ত্র নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নাগরিকের ও মানুষের ন্যায্য বিচার পাইবার অধিকারকে সমর্থন করে। সেই গণতন্ত্রের পরিসর তুরস্ক মুছিয়া দিতেছে। কী করিতে নাই, সেই শিক্ষাটি তুরস্ক হইতে লওয়া সম্ভব ও উচিত।