প্রতীকী ছবি।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা নদিয়া, মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলিতে স্কুলের গণ্ডি পেরোনো বহু বেকার যুবক জীবিকা বলতে বোঝেন দিনমজুরি, রাজমিস্ত্রি বা কাঠের কাজ। এ ছাড়া রুজি-রোজগারের বিশেষ রাস্তা নেই। সীমান্তের কড়াকড়ির জন্য এলাকার বহু মানুষের রোজগারের অন্য অনেক পথই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই এলাকার অনেকেই পাড়ি দেন ভিন্রাজ্য কিংবা বিদেশে। গত কয়েক বছরের ট্রেন্ড হল ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া। মূলত অভাবের তাড়নায় সীমান্ত লাগোয়া এলাকার বহু বাসিন্দা ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে যাচ্ছেন। আর এই মানুষগুলোর মধ্যে অনেকেই দালাল-যোগে বিদেশ পাড়ি দিয়ে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এই রাজ্য থেকে অন্য দেশে কাজ করতে গিয়ে প্রতারণা ও অনিয়মের অভিযোগে নবতম সংযোজন নদিয়ার হাঁসখালির আট বাসিন্দার আফ্রিকার তানজানিয়ায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে জেলবন্দি হওয়া।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় ৩৭,০০০ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। শুধু এ রাজ্যের জেলা নয়, ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম— প্রান্তিক মানুষ রুজির টানে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। জাতি সঙ্ঘের রিপোর্ট অনুযায়ী ১.৮ কোটি ভারতীয় বিদেশে আছেন। বিশ্বের অন্য কোনও দেশে এত মানুষ দেশের বাইরে থাকেন না। ভারত থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমশক্তি রফতানি হয়। এমন কাজে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েই আছেন। বিদেশে যাওয়া মানেই স্বপ্নপূরণ নয়। স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত নিপীড়িত হচ্ছেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার জন্য বা সেই দেশের আইন না জানার কারণে অনেকে বিভিন্ন দেশের জেলে বন্দি। সংবাদে প্রকাশ, এই সব হতাশ ও মানসিক অবসাদগ্রস্ত নির্যাতিত শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। যাঁরা বিদেশে কাজের আশায় যাচ্ছেন তাঁদের মাত্র দশ ভাগ শ্রমিকের ভাগ্যের উন্নতি হচ্ছে, বাকি নব্বই ভাগই অতি কষ্টে দিন গুজরান করছেন। উন্নত জীবনযাপনের আশায় ভিটেমাটি বিক্রি করে কিংবা উচ্চ হারে সুদে টাকা ধার নিয়ে বিদেশে যাওয়া এ দেশের লোকজন একেবারেই ভাল নেই। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে অনেকেরই বিদেশের মাটিতে মৃত্যু হয়। নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ ভাগ্যক্রমে বহু কষ্টে দেশে ফিরে আসতে পারছেন। এই শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা প্রতারক ও দালালদের খপ্পরে পড়েন, অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে প্রতিশ্রুতি মতো কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে এসে দেনার দায় মাথায় নিয়ে অকুল পাথারে পড়েন। যে সব বেসরকারি সংস্থা বিদেশে কর্মী পাঠায়, তারা কর্মী খোঁজার ক্ষেত্রে মূলত স্থানীয় দালালদের উপরে নির্ভরশীল। এ সব দালালরা বিদেশে যেতে প্রকৃত যে খরচ হয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থ নেয় বিদেশে যেতে চাওয়া শ্রমিকদের থেকে। অন্য দিকে, যে সব কর্মী বিদেশে গিয়ে কাজ পান, সেখানে যাওয়ার পরে অন্য কোনও উপায় না থাকায় চুক্তির থেকে কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন।
প্রতি বছর যত ভারতীয় বিদেশে কাজের উদ্দেশে যান, তার মধ্যে ৭-৮ লক্ষ ভারতীয় যান ‘ইমিগ্রেশন চেক রিকুয়ার্ড’ (ইসিআর) গোষ্ঠীভুক্ত দেশে। এ দেশগুলি হল— আফগানিস্তান, বাহরিন, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, জর্ডন, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, ওমান, সৌদি আরব, সুদান, সিরিয়া, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইয়েমেন। বেশিরভাগ শ্রমিকেরা স্বল্প শিক্ষিত, অদক্ষ বা খুবই অল্প দক্ষ। তাদের ‘ইসিআর’ ছাপ মারা পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। বিদেশে কাজের সন্ধানে যেতে হলে তাঁদেরকে কোনও ‘প্রোটেক্টরস অব ইমিগ্রেশন’ ( পিওই) অফিস থেকে ‘ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ নিতে হয়। যা শ্রমিকদের কাজের চুক্তি নিশ্চিত করে। সর্বোপরি তাঁদের আর্থিক, মানবাধিকার ও প্রবাসী ভারতীয় বিমা যোজনার (পিবিবিওয়াই) নিরাপত্তা প্রদান করে।
এ ছাড়াও উচ্চ শিক্ষিত ও সুদক্ষ পেশাদার কর্মীরা কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে যান জীবিকার সন্ধানে। যেখানে স্থানীয় আইন দ্বারা শ্রম ও চাকরির চুক্তি যথেষ্ট পাকাপোক্ত ও শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষিত। এই সমস্ত দেশে কর্মসূত্রে যাওয়া বা থাকার জন্য কোনও ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। এই দেশগুলি ‘ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স নট রিকুয়ার্ড’ (ইসিএনআর) হিসাবে চিহ্নিত। সংক্ষেপে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারন্স-এর মূল উদ্দেশ্য হল বিদেশে যাওয়ার আগে সঠিক ভাবে প্রশিক্ষিত হওয়া।
দক্ষিণ এশিয়া থেকে কাজে যাওয়া শ্রমিকেরা সৌদি আরব ও পারস্য উপসাগরের অন্য আরব দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তাঁদের উপর নির্যাতন ও শোষনের ঘটনাগুলো খুবই মর্মান্তিক। অভিযোগ, দেশের সরকারও সে ব্যাপারে উদাসীন। তাঁদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রচুর উদাহরণ রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল হোরাল্ড ট্রিবিউন রিপোর্ট অনুযায়ী, কুয়েতে ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বিদেশি শ্রমিক এবং সংযুক্ত আরবশাহিতে মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ বিদেশি শ্রমিক। এই সব দেশে ভারতীয় শ্রমিকরা ৪৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কাজ করে দৈনিক মাত্র এক ডলার বেতন পান। যে দেশে ধনী লোকেরা ১০০০ ডলার মূল্যের হোটেলের ঘরে থাকেন সে দেশে এই শ্রমিকেরা ভোরে আর্মি বেইজের মতো পাহারায় ঘেরা ক্যাম্পে ঘুম থেকে উঠে সপ্তাহে ছ’দিন প্রহরায় থেকে কাজ করেন।
‘উত্তর সম্পাদকীয়’ বিভাগে
লেখা পাঠান এই ইমেল-এ
edit.msd@abp.in
ইউনিকোড হরফে লেখা পাঠালেই ভাল হয়। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
(চলবে)
শিক্ষক, শিকারপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়