শৈশবের সীমা কোথায়, সেই ধন্দ চিরকালীন। প্রদ্যুম্ন ঠাকুর হত্যায় অভিযুক্ত কিশোরকে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ ধার্য করিয়া বিচারের সিদ্ধান্তে ফের সেই বিতর্ক উঠিল। জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের রায়, পরিণাম বুঝিয়া, পরিকল্পনা করিয়াই খুন করিয়াছে ওই কিশোর। তাহার বয়স ষোলো বৎসর হইলেও মন পরিণত। অতএব বিচার ও শাস্তি প্রাপ্তবয়স্কের ন্যায় হওয়া প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্তের ফলে ওই কিশোরকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির অধীনে সাত বৎসর বা তাহারও অধিক কারাবাসের সম্ভাব্য সাজার সম্মুখে দাঁড়াতে হইবে। প্রশ্ন উঠিতে পারে, অপরাধ যতই গুরুতর হউক, শিশু-কিশোরের জন্য নির্ধারিত আইনি ব্যবস্থা (সরকারি হোমে রাখিয়া সংশোধন ও পরিবারে পুনর্বাসন) হইতে এক কিশোর কেন বঞ্চিত হইবে? শৈশব-কৈশোরে মস্তিষ্ক তথা মন অপরিণত হইবার কারণে অপরাধের গুরুত্ব অনুভব করা কঠিন, বিজ্ঞানও সে কথা সমর্থন করে। পরিবার ও পারিপার্শ্বিকের উপর শিশু-কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ সামান্যই। প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হইয়া হিংসাত্মক কাজ করিয়া ফেলে তাহারা। তাই শাস্তি অপেক্ষা সহানুভূতি ও সুরক্ষা তাহার অধিক প্রয়োজন। এই চিন্তা হইতেই শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হইয়াছিল। তাহার সুযোগ হইতে কোনও শিশুকেই বাদ দেওয়া অন্যায়।
প্রতিপক্ষের বক্তব্য, সমবয়সিদের মধ্যেও সকলের মানসিক বয়স এক নহে। ষোলো বৎসরের ঊর্ধ্বে কিশোরদের মানসিক পরিপক্বতা বিচার করিয়া তাহাদের বিচারের পদ্ধতি স্থির করায় ক্ষতি নাই। বিশেষত যৎসামান্য শাস্তির আশ্বাসের সুযোগ লইয়া যাহারা ভয়ানক অপরাধ করিতেছে, তাহারা শিশু-কিশোরের প্রাপ্য সুরক্ষা পাইবে কেন? অপরাধ করিলেও শাস্তি হইবে না— এই নিশ্চয়তা থাকিলে কিশোর অপরাধীর অপরাধপ্রবণতা প্রশ্রয় পাইতে পারে, এই যুক্তি উড়াইয়া দিবার কোনও উপায় নাই। গত বুধবার দিল্লিতে কয়েক জন নাবালকের বিরুদ্ধে এক তরুণীকে গণধর্ষণের যে অভিযোগ উঠিয়াছে, তাহা এই বিপদকে স্পষ্ট ভাবে চিনাইয়া দেয়। কিন্তু এই প্রশ্নগুলিকে যুক্তির আলোয় বিচার করা এক কথা, আবেগ দিয়া দেখা অন্য কথা। অভিজ্ঞতা বলিতেছে, কিশোর অপরাধীর কঠোর শাস্তির দাবি তখনই প্রবল হয়, যখন কোনও ভয়ানক অপরাধ জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। পাঁচ বৎসর পূর্বে নির্ভয়া কাণ্ডে অপরাধীদের চরম শাস্তির দাবি উঠিয়াছিল। সেই অপরাধের অংশীদার এক কিশোর সামান্য সাজার পর মুক্তি পাইতে পারে, সেই ক্ষোভের জেরেই আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। নূতন আইন শর্তসাপেক্ষে ষোলো বৎসরকে শৈশবের সীমা নির্ধারণ করিয়াছে।
আজ সেই পরিবর্তিত আইন প্রয়োগ করা হইতেছে আর এক অপরাধ লইয়া জনরোষের জেরে। অভিযুক্ত কিশোরকে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ গণ্য করিবার সিদ্ধান্তকে প্রদ্যুম্নের পরিবারের আইনজীবী ‘ঐতিহাসিক’ বলিয়াছেন। ভারতে শৈশবকালের কোন ইতিহাস রচনা হইল? যথেষ্ট শাস্তি হইল কি না, ন্যায়বিচারে ইহাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হইতে পারে না। অপরাধী ও অভিযুক্ত, উভয়ের প্রতিই ন্যায় হইল কি না, ইহাই প্রধান প্রশ্ন। নিহতের পরিবার অপরাধীর চরম শাস্তি চাহিবে, আশ্চর্য নহে। কিন্তু শিশু-কিশোরের স্বার্থের সুরক্ষা যাহাদের দায়িত্ব, সেই জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সদস্যরাও যে ষোলো বৎসরের কিশোরকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির অধীনে ঠেলিয়া দিলেন, তাহা চিন্তার উদ্রেক করে। কে শিশু, কে নহে, তাহা প্রতিটি ঘটনায় বিচার করিতে গেলে শিশুর অধিকারের ধারণাটিই বিপন্ন হইয়া পড়িতে পারে। কাল যদি চৌদ্দ বৎসরের বালকের দ্বারা খুন-ধর্ষণের ঘটনা জনরোষ প্রবল হয়, তবে কি আইন বদলাইয়া শৈশবের সীমা চৌদ্দয় নামিবে?