Depression

বিষাক্ত সম্পর্ক চেনা দরকার

কেউ প্রশ্ন করছেন, এত ঝকঝকে, ভাল ছেলের কি ডিপ্রেশন হতে পারে? অদ্ভুত ভাবনা।

Advertisement

শ্রীরূপা সরকার

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

বলিউডে এক তারকার মৃত্যু অনেককেই নাড়িয়ে দিয়েছে— আত্মহত্যা না হত্যা? আত্মহত্যার প্ররোচনা ছিল কি? থাকলে কার? কেন এক রূপবান, গুণবান কুমারের এই অপমৃত্যু? এর পিছনে টিনসেল টাউনের অবদান কতটা? কারা স্বজনপোষণ করে তাঁকে অবসাদের দিকে ঠেলে দিলেন? উত্তাল দেশ, দুই রাজ্যের দ্বৈরথ, সিবিআই থেকে হাজতবাস, সবই চলছে।

Advertisement

কেউ প্রশ্ন করছেন, এত ঝকঝকে, ভাল ছেলের কি ডিপ্রেশন হতে পারে? অদ্ভুত ভাবনা। ডিপ্রেশন বা অবসাদ পৃথিবীর বিদ্বানতম বা সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষেরও হতেই পারে। এ হল কেমিক্যালের খেলা, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। অবসাদ হতে পারে অনেক কারণেই, একলা হয়ে যাওয়া, কাছের/ দূরের মানুষের চাহিদা, জীবনে যা চাই তা না পাওয়ার কষ্ট, কত কিছু। কিন্তু অতশত বোঝে কে! এই অভিনেতা যথেষ্ট সফল ছিলেন, সুতরাং তাঁর সঙ্গে যে অভিনেত্রী ছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বিচার হয়েই চলেছে। এবং, সোশ্যাল মিডিয়ায় দোষীর বিচার হওয়ার আগেই সাত দিনের ফাঁসি!

যা খবর শোনা গিয়েছে, তার থেকে মনে হয় এক বিষাক্ত সম্পর্কের কথা। সবটাই তাঁর প্রাক্তন কর্মচারী ও তাঁর পরিবারের এবং বন্ধুদের উক্তি থেকে, সত্যতা জানা নেই। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধে নেই যে, বিষাক্ত সম্পর্ক মানুষকে একা, বিষণ্ণ করে তোলে। তার থেকে অবসাদ, আত্মহত্যা, সবই ঘটতে পারে।

Advertisement

আমাদের দেশে অবসাদ বা মানসিক অসুখ এখনও বড় লজ্জার বিষয়। মাথা খারাপ, মাথার গন্ডগোল, তারকাটা— কত রকম বিশেষণ জোটে। অবসাদ হলে ধরে নেওয়া হয় সেটা মানসিক দুর্বলতা। সহজে কেউ পেশাদারি সাহায্য নিতে লজ্জা বা ভয় পান। অভিনেতা, রাজনীতিবিদ, ক্রিকেটার— যাঁদের কথা মানুষ বেশি শোনেন, বিশ্বাস করেন— তাঁদের কাছে মানসিক অসুস্থতা নিয়ে ভুল তথ্য শুনলে, মন-চিকিৎসক বা মনোবিদরা যা বলছেন, তার চেয়ে অন্য কথা শুনলে বিপদ আরও বাড়ে।

বিষাক্ত সম্পর্ক বিষয়ে আমাদের অসচেতনতাই যদি এই সামাজিক অসুখের মূল হয়, সমস্যার গোড়ায় গিয়ে বোঝা দরকার, কখন কী ভাবে একটা সম্পর্ককে বিষাক্ত বলে চেনা সম্ভব। অনেকগুলো লক্ষণ আছে এর, তরুণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দেখেছি। কোনও অভ্রান্ত মডেল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা না করে, কতকগুলো সাধারণ কথা তাই বলতে ইচ্ছে করছে নিজের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। হয়তো এমন অভিজ্ঞতার অভাবেই ছেলেমেয়েরা বিপদে পড়ে।

এই যেমন, অনেক সময়ই দেখি, খুব তাড়াতাড়ি প্রচণ্ড রোম্যান্স আর প্রেম ঘটে যায়, ভালমন্দ বোঝার সময় দেয় না। অল্প দিনের মধ্যেই বিয়ে বা লিভ-ইন’এর কথা ওঠে। জানা-বোঝার আগেই সম্পর্কটা পাকাপাকি হয়ে যায়। আবার অনেক সময়, অন্য জনের দুর্বলতাকে বড্ড যেন বড় করে দেখা হয়। হয়তো সঙ্গীর কোনও দুর্বলতা, অপ্রাপ্তি, অক্ষমতা, এ সব উঠে আসে যখন-তখন, অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই। বিষয়টাকে কিন্তু হালকা করে দেখা উচিত নয়।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, এক জন মনে করছেন, সব দোষ অন্য জনেরই, তাঁর রাগ আর খারাপ ব্যবহারের কারণটাও আসলে তাঁর নয়, সঙ্গীরই। অন্য জনই তাঁকে বাধ্য করছেন খারাপ ব্যবহার করতে। এই ধরনের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ লক্ষণ— সঙ্গীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা অন্যদের থেকে— পরিবার, বন্ধু, বিশ্বাসের মানুষদের থেকে। এই ভাবে কাউকে নিজের নিকট লোকদের থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার লক্ষ্যটা স্পষ্ট হতে থাকে।

একই ভাবে, সঙ্গীর যদি বিশেষ কোনও গুণ থাকে, তা নিয়েও একটা নিরাপত্তাবোধের অতিরিক্ত অভাব থেকে যায় সঙ্কটময় সম্পর্কে। হয়তো প্রেমিক বা প্রেমিকার জীবনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাটাই তখন লক্ষ্য হয়ে ওঠে। তাঁর টাকাপয়সা, আর্থিক দেখাশোনা, কাদের সঙ্গে মিশবেন, সেটাও অন্য জন ঠিক করেন। সঙ্গীর বন্ধু হবেন নিজের বন্ধু বা পরিবারের লোক, নিজে যেটা করতে ভালবাসেন, সেটা ছাড়া কিছুই করতে দিতে চান না সঙ্গীকে।

এক জন সফল অভিনেত্রীও যখন নিজের অবসাদ নিয়ে কথা বলে ‘কেঁদে জেতা’র বদনাম পান, বোঝাই যায় সামাজিক সহানুভূতি কোন দিকে। সুতরাং মানসিক অসুস্থতা কিংবা অশক্ত ভাব প্রকাশ পেলে কেরিয়ারের ক্ষতি হওয়ার ভয় তো থাকেই।

এর মধ্যেই কয়েকটা জিনিস খেয়াল রাখা খুব কঠিন নয়। সম্পর্কে দু’রকম ব্যবহার বা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আছে কি না, খেয়াল রাখা ভাল। এক জন নিজের খুশিমতো কাজ করেন, কিন্তু অন্য জনকে সব কিছুর জন্য অনুমতি নিতে হয়, এটা সুস্থ সম্পর্কের লক্ষণ নয়। তেমনই, নিজের রোজগারের হিসেব দিতে হয় না, কিন্তু অন্য জনের টাকার হিসেব রাখা হয়, এটা অসম সম্পর্কের গোড়ার কথা।

সহমর্মিতার অভাবকেও আমাদের সমাজে বড় ‘স্বাভাবিক’ মনে করা হয়— বিষয়টা কিন্তু স্বাভাবিক নয়, সুস্থ তো নয়ই। সঙ্গী যখন একা বা বিষণ্ণ, তখন তাঁকে মানসিক ভাবে দুর্বল বলে কষ্ট দেওয়া কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। ব্যাপারটা এক ধরনের অত্যাচারের পর্যায়েও পৌঁছে যেতে পারে।

ব্ল্যাকমেল করা, গালাগালি দেওয়া, দৈহিক ও মানসিক আঘাত করা— এ সব তো অন্য স্তরের আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তি। কথা হল, এই স্তরে পৌঁছনোর আগেই কিন্তু সমস্যাটাকে ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখা ভাল, সাবধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোনও সম্পর্কই জীবনের চেয়ে বড় নয়। আরও বড় কথা, সম্পর্ক কিন্তু জীবনকে সুন্দর করার জন্য। সম্পর্কের জন্য যদি কেউ ভীত, সন্ত্রস্ত, নিরাশ, হতাশ, লজ্জিত বোধ করেন, তা হলে সেটা সুন্দর তো নয়ই, সুস্থও নয়। সুস্থ সম্পর্কে এক জন সঙ্গী অন্য জনকে সাহায্য করবেন, বুঝবেন, তাকে সুখী দেখার ও করার চেষ্টা করবেন। ‘সম্পর্ক’ বিষয়টা নিয়ে আমাদের এ বার একটু ফিরে খোলা মনে ভাবা দরকার।

শেষে বোধ হয় বলা দরকার— কারও সঙ্গে মিল পেলে, সেটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়!

ডেভলপমেন্টাল সাইকলজি বিভাগ, ওয়ালডেন ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement