প্রতীকী চিত্র।
ভারতে কৃষিজমির দাম এখন পৃথিবীর শীর্ষে। নজিরবিহীন। এই দাম আর ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা সরকারের নেই। জবরদস্তিও চলে না আর। এ-দিকে চাষজমি আরও খণ্ডিত হচ্ছে, মালিকের সংখ্যা বাড়ছে। হাজারটা মালিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করার সামর্থ্য নেই। কয়েকশো বা কয়েক হাজার একর একত্রে কেনা সহজ কথা না। অথচ একটা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে অন্তত দু’হাজার একর জমি লাগবে, বড় বাঁধ তৈরি করতে দু’লক্ষ একর। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল সরকার। ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’-এর কথা শোনা গিয়েছে, যা তেমন কাজের নয়।
জমির মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষমতা ও সুযোগ বেড়েছে জমি-মালিকের। জবরদস্তি দূরস্থান, ওঁদের খুশি করা দরকার। কেড়ে নেওয়া না গেলে আপস করতে হয়। প্রকল্পের অংশীদার বানাতে হয়। এমন বোঝাপড়ায় আসতে হয় যাতে দু’পক্ষই ভাবেন, আমরা জিতেছি, অন্তত হারিনি। এই নতুন বাস্তবে অন্য রাজ্যে দেখছি তিনটি পদ্ধতির ব্যবহার।
প্রথমটি চেনা, লিজ় বা ইজারা। যে জমিতে বছরে একরপ্রতি ত্রিশ হাজার টাকা রোজগার হয়, সেখানে ষাট হাজার টাকায় ইজারা নিন। কুড়ি হাজার টাকা রোজগার হলে চল্লিশ হাজার টাকা দিন। মালিকের সুবিধে, জমির মালিকানা বজায় থাকে, চাষের ঝুঁকি-ঝামেলায় না গিয়ে আয়ও দ্বিগুণ হয়ে যায়। আবার, যিনি ইজারা নিচ্ছেন তাঁকে থোক টাকা বার করতে হয় না। ধীরে ধীরে, বছরে বছরে খরচ হয়। সব টাকা জমিতে না গিয়ে, প্রকল্পের জন্যেও কিছু বাকি থাকে। হ্যাঁ, জমির দাম যেখানে একরপ্রতি বিশ লক্ষ বা তারও বেশি, মালিক ইজারায় খুশি হবেন না, আরও টাকা চাইবেন। কিন্তু শহর থেকে দূরের জমি, যেখানে সেচব্যবস্থা নেই, খাটনি আর ঝুঁকি প্রচুর, সে সব এলাকায় ইজারার কথা বিবেচনা করা উচিত, চাষের বদলে অন্য ব্যবহারের জন্য।
দ্বিতীয় পদ্ধতিটি ‘ল্যান্ড পুলিং’ বা জমি একত্রীকরণ। এতে সরকারের নেতৃত্বে বাসযোগ্য বা ব্যবহারযোগ্য এলাকার জমি একত্র করে তা উন্নত করা হয় পরিকাঠামো তৈরি করে (রাস্তা বিদ্যুৎ ইত্যাদি), উন্নত জমির শতকরা ৬০ থেকে ৮০ ভাগ ফেরত দেওয়া হয় মালিককে। মালিকানার বেশির ভাগটাই বজায় থাকে, ফেরত-পাওয়া জমির মূল্যবৃদ্ধির ফলে লাভও হয়। অধিগ্রহণের খরচ বাঁচে, বিবাদও বাধে না। এই পদ্ধতি বম্বে প্রেসিডেন্সিতে ব্যবহার করত ইংরেজ সরকার। স্বাধীনতার পর গুজরাতে এর বহু ব্যবহার হয়। এখন নানা রাজ্যে এই নীতি তৈরি হচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশের নতুন রাজধানী অমরাবতী তৈরি হচ্ছে উনত্রিশটি গ্রামের আটত্রিশ হাজার একর জমি ল্যান্ড পুলিং করে। জমির মালিকরা থোক কাঁচা টাকা পাচ্ছেন, ফেরত পাবেন তাঁদের উন্নত জমির বেশির ভাগটাই।
তৃতীয় পদ্ধতি এরই একটি সর্বাধুনিক রূপান্তর। কিছু বিশেষজ্ঞ এর নাম দিয়েছেন ‘শেয়ারহোল্ডিং’ বা অংশীদারি পদ্ধতি। এখানে জমির মালিকরাই একত্রিত হয়ে বিনিয়োগকারীকে বলেন, ‘‘আমাদের জমি ব্যবহার করুন, শহর বানান বা কারখানা বসান। আমরাই মালিক থাকব, জমির বাজারে যা লাভ হবে আমরাই রাখব।’’ মহারাষ্ট্রে মাগারপাট্টা আর খেদ নামে দু’টি নতুন শহর বা শহরতলি তৈরি হয়েছে এই পদ্ধতিতে। মাগারপাট্টা পুণের উপশহর, অনেকে হয়তো দেখেছেন ‘অন্ধাধুন’ ছবিটিতে।
চাষের জমির বাণিজ্যিকীকরণের ব্যাপারটা শুধু অধিগ্রহণে সীমিত নয়, এর নানা মাত্রা। কোথায় কী বসবে, করের হার কতটা হওয়া উচিত— জমির যথাযথ ব্যবহার নিয়ে নানা প্রশ্ন শুধু চাষজমি নিয়ে ওঠে না, ওঠে শহরের জমি নিয়েও। পঞ্চাশ বছর আগে জমি-সংক্রান্ত আলোচনা হত জমির বণ্টন বা বিভাজনে সংশোধন নিয়ে। কিন্তু চাষজমির গড় আয়তন যখন খুব ছোট হয়ে যায়, তখন বণ্টনের জন্য কিছু বাকি থাকে না।
সে-কালে জমি অধিগ্রহণ অনেক হত, কিন্তু তা নিয়ে নাগরিক সমাজে আলোচনা হত না, কারণ অধিগ্রহণের শিকার ছিল গরিব চাষি আর শিকারি ছিল শিক্ষিত সমাজ, যাকে আমরা ‘মধ্যবিত্ত’ বলি, কিন্তু যা আসলে উচ্চবিত্ত। এখন জমি নিয়ে ভাবতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে, কী প্রকাণ্ড এবং অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে জমির বাজারে। সেই বাজারে লাভ করতে পারেন সব স্বার্থগোষ্ঠী— জমির মালিক, জমিহীন কৃষক, আর সরকার। কিন্তু জনসাধারণের স্বার্থ ভুললে হবে না। জমিতে এখন এত টাকা আছে যে ঠিক নীতি বানালে, বুদ্ধিমানের মতো নিয়ন্ত্রণ করলে, সমাজের লাভ হবে। কাজটি সহজ নয় কিন্তু অসম্ভবও নয়। দরকার জানার ইচ্ছা, শেখার ইচ্ছা, সব কিছু দলীয় রাজনীতির দৃষ্টিতে না দেখে অর্থনীতি আর উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝার চেষ্টা। সে আশা কি আমরা করতে পারি না?
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
(শেষ)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক