—ছবি পিটিআই।
শ্যামাপূজা ও দীপাবলি আসিলে বঙ্গভূমি এক রঙ্গমঞ্চ হইয়া দাঁড়ায়। শব্দবাজি থামাইবার পরিচিত চিত্রনাট্য মানিয়া পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা নির্দিষ্ট কাজে নামিয়া পড়েন। যথা, আইনের প্রতি কদলী প্রদর্শন করিয়া বাজি ফাটাইবার জন্য বিখ্যাত এলাকাগুলির মানচিত্র নির্মাণ। চকলেট-দোদমাবর্ষণে সুপরিচিত পাড়ায় সচেতনতা অভিযান। বহুতল বাড়িগুলিকে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। শহরের নির্দিষ্ট কিছু বাজার হইতে বাজি কিনিবার আবেদন এবং গুটিকতক দোকানের মাল কাড়িয়া দোকানিকে শাসন। বিকট আওয়াজে গান বাজাইবার যন্ত্রকে নিষিদ্ধ করিতে বাড়তি নজরদারিও সম্প্রতি যোগ হইয়াছে। তদুপরি এই বৎসর সুপ্রিম কোর্ট শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিবার ফলে পুলিশের তৎপরতাও কিছু বাড়িয়াছে। কিন্তু তাহাতে বিশেষ আশ্বস্ত হইয়াছেন রাজ্যবাসী, এমন ইঙ্গিত মেলে নাই। তাঁহাদের অভিজ্ঞতা, প্রতি বৎসর আইনরক্ষার আড়ম্বরের শেষ হয় কালীপূজা ও দীপাবলির রাতে সকল নিয়মভঙ্গে, শব্দবাজির অবাধ তাণ্ডবে। বৃদ্ধ ও শিশুর অসহায়তায়, পাখি ও প্রাণীদের আতঙ্কে। এই প্রহসন বন্ধ হইবে কবে? কেন বাজি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাই নিয়ম হইয়াছে? সহজ সত্য ইহাই যে, শব্দবাজি এক বার উৎপন্ন হইলে বিপণন হইতে বিস্ফোরণ পর্যন্ত তাহার গতি অপ্রতিরোধ্য। তাহাকে আটকাইবার সামর্থ্য কার্যত কাহারও নাই। নিষেধাজ্ঞা যদি বলবৎ করিতেই হয়, তবে তাহার উৎপাদনকে সমূলে বিনাশ করিতে হইবে। এই কাজটি বস্তুত পুলিশের এত দিন করিয়া ফেলা উচিত ছিল, কারণ অবৈধ বাজি প্রস্তুতির কারখানাগুলিও অবৈধ। এলাকাবাসী ও কর্মীদের জন্য অতিশয় বিপজ্জনকও। প্রতি বৎসরই অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে হতাহতের সংবাদ মেলে। নাগরিক সুরক্ষার প্রথম কর্তব্যটি কী করিয়া উপেক্ষা করিতে পারে পুলিশ?
মূলেই বিনাশ— এই কৌশল যে সর্বাধিক কার্যকর, প্রশাসন বা পুলিশের তাহা অজানা নহে। তবু যে সহজ পন্থাটি উপেক্ষিত হয়, তাহা কি অপরাধের প্রতি প্রশ্রয়ের কারণে নহে? সম্মুখে রক্তচক্ষু, আড়ালে অভয়হস্ত, এই দ্বিচারিতার জন্যই কখনও বাজির দোকান তুলিতে, কখনও শব্দবাজি ফাটানো বন্ধ করিতে পুলিশ দৌড়াদৌড়ি করে। এই ভাবেই গ্রামে গ্রামে চোলাই মদ উৎপাদন অবাধে হইয়াছে, অতঃপর কতিপয় মদের ভাটি ভাঙিয়াছে পুলিশ। বিষমদে মৃত্যু হইলে খুনের ধারা দিয়াছে মালিকের বিরুদ্ধে। এই ভাবেই তামাকজাত দ্রব্য বাজারে আসিয়া পড়ে, অতঃপর তাহার অপকারিতা প্রচার করিতে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করিয়া থাকে। একই কারণে প্লাস্টিকের দ্রব্য সর্বত্র ছড়াইবার পর এলাকা প্লাস্টিকমুক্ত করিবার আবেদন করিতে হয় সরকারকে। চোলাই মদ, তামাক, শব্দবাজি অথবা প্লাস্টিক ব্যবহারে কাহারও ‘অধিকার’ নাই, এগুলি দাবি করিবার বস্তু নহে। এগুলির বর্জনই সরকারি নীতি। তা হলে এগুলির উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করা হইবে না কেন? সমস্যা কোথায়?
সমস্যা সেই পুরাতন, সরিষার মধ্যে প্রবিষ্ট ভূত। সেই ভূতের নৃত্য সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিকরা নিত্য দেখিয়া থাকেন। মাঝেমধ্যে তাহা বৃহত্তর পরিসরেও প্রকট হইয়া পড়ে। কলিকাতায় পুরপ্রতিনিধির বাসভবন হইতেই প্রচুর বাজি উদ্ধার হইয়াছে। মেদিনীপুরের পিংলাতে ২০১৫ সালে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর গ্রামবাসী অভিযোগ করিয়াছিলেন, কারখানার অংশীদার তথা বাড়ির মালিক রঞ্জন মাইতি ছিলেন শাসক দলের ঘনিষ্ঠ কর্মী। নিষিদ্ধ ব্যবসার লাভের গুড়ের প্রতি লোলুপতা থাকিলে তাহাকে সমূলে বিনাশ করিতে অনাগ্রহ অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু শব্দবাজির ভয়ানক উৎপীড়নের প্রতি এমন প্রশ্রয় রাজধর্মের একান্ত বিরোধী।