প্রস্তুতি: সিএএ-এনআরসি’র প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিলিগুড়ি, ৩ জানুয়ারি, ২০২০। পিটিআই
নাগরিকত্ব আন্দোলনের উত্তাপ এখনও তীব্র। তারই মধ্যে পুরভোটের বাদ্যি বেজে উঠেছে। বোর্ডের পরীক্ষা পর্ব মিটলেই ভোট করার জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো এপ্রিল নাগাদ ভোটপর্বের সূচনা হবে। কলকাতা-সহ শ’খানেক পুরসভার ভোটের গুরুত্ব এ বার অন্য রকম। রাজ্যের একশোটি শহর এলাকার জনমত আগামী বিধানসভা ভোটের আভাস পেতে কিছুটা সহায়ক হবে। হাওয়া বোঝা গেলে শাসক, বিরোধী সকলেই নিজেদের মতো করে পরবর্তী অঙ্ক কষতে পারবে। বস্তুত পুরভোটের পরে বিধানসভা ভোটের জন্য হাতে সময় থাকবে বড়জোর বছরখানেক। সেটা খুব বেশি নয়। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাই এটা শাসক তৃণমূলের কাছে কিছুটা জমি জরিপের মতো। তৃতীয় দফায় সরকার গড়ার লক্ষ্যে চূড়ান্ত দৌড় শুরু করার ক্ষেত্রে তাদের জন্য এই জরিপ জরুরি।
মঞ্চটি পুরভোটের হলেও দেশ জুড়ে নাগরিকত্ব আন্দোলনের আবহে সেটিকেই হয়তো প্রচারের প্রধান অভিমুখ করে তুলতে চাইবে শাসক দল। এতে তাদের সুবিধা বেশি। এক, রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে এটি অধিক কার্যকর হতে পারে। দুই, স্থানীয় বিষয়গুলি তুলনায় কিছুটা চাপা পড়তে পারে।
সর্বোপরি নাগরিকত্ব-উদ্বেগ প্রচারের আলোয় এনে ভোট হলে বিজেপি কোথায় দাঁড়িয়ে জনমতের ভিত্তিতে, তার একটা ন্যূনতম ধারণা পুরভোটের ফল থেকে মিলতে পারে।
রাজনীতির পণ্ডিতেরা অনেকে অবশ্য মনে করেন, পুরভোট নিতান্তই স্থানীয় বিষয় ভিত্তিক। ছোট ছোট এলাকার চাওয়া-পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দই সেখানে বড়। জাতীয় রাজনীতি দূরের কথা, রাজ্য রাজনীতির প্রতিফলনও এখানে সে ভাবে ঘটে না। তবে ভিন্ন মত হল, বিবেচনার এত সূক্ষ্মস্তর সাধারণ ভোটারের মাথায় থাকে না। যিনি লোকসভা-বিধানসভার ভোটদাতা, তিনিই পুরসভা, পঞ্চায়েতে ভোট দেন। তাই রাজনীতির মূল ছবিটি তাঁর মাথায় থাকে। ভোট দেওয়ার সময় সেটি কাজও করে।
দুই যুক্তির কোনওটিই সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। গত লোকসভা ভোটে সারা দেশে বিজেপি-বিরোধীরা ঘা খেয়েছিল। এই রাজ্যেও বিজেপি-বিরোধী দল তৃণমূল বড় ধাক্কা খায়। কিন্তু পর্যালোচনায় বসে তৃণমূল নেতৃত্ব এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক ভোট-বিভাজনের মতো বিষয়ের সঙ্গে শহর, গ্রাম সর্বত্র পুরসভা ও পঞ্চায়েত স্তরে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও বহু জায়গায় শাসক দলকে বেগ দিয়েছে। তাঁদের ভাবমূর্তি এবং কৃতকর্মের মাসুল দিয়েও দলকে অনেক ভোট হারাতে হয়েছে। যার ফসল ঘরে তুলেছে বিজেপি।
সেই চাপ থেকেই স্বয়ং মমতাকে হাল ধরতে হয়। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ উদ্গিরণের পথ খুলে দিতে তিনি ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি চালু করেন। পাশাপাশি নিজের দলের একাংশের দিকে আঙুল তুলে তিনিই প্রথম ‘কাটমানি’র বিরুদ্ধে সরব হন। তার পরে চার দিক থেকে কাটমানি ফেরতের দাবি ঘিরে তৈরি হয় এক ঘোরালো পরিস্থিতি। বোঝা যায়, কতটা ক্ষোভ জনমনে পুঞ্জীভূত ছিল।
বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে মমতা লোকসভা ভোট পরবর্তী কয়েক মাসে অবস্থা কিছুটা হলেও সামাল দিতে পেরেছেন, এটা মানতেই হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত যা হয়েছে, সেটা মূলত ক্ষতে প্রলেপ। এখন সময় ‘সংশোধিত’ অবয়ব লোকচক্ষে তুলে ধরার। কারণ এ বার সরাসরি পুরনির্বাচন।
নাগরিকত্ব আন্দোলন বিজেপির রাজনীতির বিরুদ্ধে শাসক দলের অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। ভোটের বাক্সে তার প্রভাব পড়াও অস্বাভাবিক নয়। তবে এ-সবের পাশাপাশি এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রয়োজন যাতে মানুষ বোঝেন, ভাবমূর্তি ও স্বচ্ছতার প্রশ্নেও কোনও আপস করা হবে না। বিধানসভা ভোটে যাওয়ার আগে এটা প্রমাণ করাও কিন্তু শাসক দলের কাছে এক বড় পরীক্ষা। সেই দিক থেকেও এ বারের পুরভোটের তাৎপর্য বহুমুখী।
ভাবমূর্তির প্রথম ধাপ সঠিক প্রার্থী বাছাই। যে কোনও দলের সমর্থনের ভিত একেবারে নিচুতলায় জনপ্রতিনিধিদের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। আগেই বলেছি, পুরসভা বা পঞ্চায়েতের মতো তৃণমূল স্তরে নির্বাচিতদের সম্পর্কে যদি বিরূপ ধারণা তৈরি হয়, তবে সেটা সংশ্লিষ্ট দলকে উপরের দিকে ধাক্কা দেবেই। কারণ কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত সদস্যেরা বিধায়কদের জন্য প্রাথমিক পরিসর তৈরি করে দেওয়ার কাজ করে দিতে পারেন। তাঁরা ভাল কাজ করলে সেখানকার বিধায়কদের সুবিধা হয়। শাসক দলের ক্ষেত্রে এটা আরওই প্রযোজ্য। শাসকের হাতে দেওয়া ও নেওয়া, দুই ক্ষমতাই বেশি।
লোকসভা নির্বাচনের পরে তৃণমূল নেতৃত্ব ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরকে পরামর্শদাতা হিসেবে ডেকে এনেছেন। লক্ষ্য, আগামী বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে জমি তৈরির জন্য তিনিও আসন্ন পুরভোটকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। কী ভাবে কী ছকে তিনি ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, সে সম্পর্কে বিশদ তথ্য জানা নেই। তবে এটা জানি, তিনিও প্রার্থীদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট খতিয়ে দেখার পক্ষপাতী। শাসক দলের বিভিন্ন বৈঠকে খোলাখুলি সে কথা বলেছেন।
অবস্থাটি আঁচ করা গিয়েছে হাতেকলমে। কলকাতার কথাই ধরা যাক। পাড়ায় পাড়ায় ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচিতে এলাকার তৃণমূল কাউন্সিলরেরা জনতার মুখোমুখি হয়েছেন। সে-সবের রিপোর্ট বহু ক্ষেত্রে শাসক দলের পক্ষে স্বস্তিকর নয়। অনেক কাউন্সিলর সম্পর্কে এলাকার মানুষ অভিযোগ গোপন করেননি। যে সব জায়গায় কাটমানির ক্ষোভ প্রকাশ্যে এসেছে সেখানে তো বটেই, অন্যত্রও বেশ কয়েক জন কাউন্সিলরের ভাবমূর্তি খুবই ধূসর প্রতিপন্ন হয়েছে। খোলা দরবারে প্রশ্নের মুখে তাঁদের কার্যত পালিয়ে বাঁচার দশা হয়েছে।
এর নেপথ্য কারণ নিয়ে বহু বার আলোচনা হয়েছে। তবু প্রসঙ্গত আবার বলতে হচ্ছে। বাবা-ছেলে, স্ত্রী-স্বামী, দাদা-ভাই, বৌদি-দেওর ইত্যাদি বিবিধ ‘কম্বিনেশন’ তৈরি করে পুর-প্রতিনিধিদের একাংশ ব্যক্তিগত আখের গোছানোর কাজটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পেরেছেন। যেমন, বাবা কাউন্সিলর, ছেলে পাড়ার দাগি তোলাবাজ। কিংবা কাউন্সিলর স্ত্রীকে সামনে রেখে সিন্দুক ভরেন স্বামী। অথবা কাউন্সিলর দাদাকে ভাঙিয়ে পরিপুষ্ট হন ভাই! শুধু কি তা-ই? এক-এক জনের রাতারাতি বদলে যাওয়া জীবনযাপন দেখা বা বেনামে বাড়ি-গাড়ি করার খবরও হাওয়ার বেগে ছড়ায়।
দল হয়তো প্রশ্ন তুলবে, অভিযোগ উঠলেই তাকে সত্য বলে ধরতে হবে কেন? যুক্তি একেবারে ভুল, তা বলব না। হতে পারে, এমন দোষীর সংখ্যা প্রচুর নয়। কিন্তু রাজনীতিতে ‘পারসেপশন’ বলে একটি বিষয় আছে, যা অতি ভয়ঙ্কর। এলাকার মানুষ যাকে চোখের সামনে দেখতে দেখতে ধরে নেন, সেই ব্যক্তি ‘ঠিক’ নন, তা হলে তাঁর পক্ষে কোনও ওকালতিই কাজে আসে না। তিনি জিতলেও সাধারণ বোধে ধরে নেওয়া হয়, সেই জয় ঠিক পথে আসেনি। ‘শরবত’-এ বিষ আছে! সবচেয়ে বড় কথা, মুষ্টিমেয়র জন্য কাদার ছিটে লাগে গোটা দলের গায়ে। একেই বলে পারসেপশন। পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা, সর্বস্তরে, সর্বদলে এমন অনেক নজির আছে।
এখন পুরনির্বাচনের প্রার্থী তালিকায় মানুষ যদি দেখেন, যাঁদের নিয়ে প্রশ্ন বা ক্ষোভ জমেছে, তাঁরাই আবার শাসক দলের টিকিট পেয়ে ‘জনসেবা’র সুযোগ নিতে নেমে পড়েছেন, তবে তার প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হতে পারে না। সেই মুখগুলি ছলে-বলে-কৌশলে জিতে এলেও সামগ্রিক ভাবে তাতে দলের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে এবং বিধানসভা ভোটের আগে অন্য বার্তা ছড়াবে।
তাই নাগরিকত্ব আন্দোলন পুরভোটের প্রচারে যতই বড় মাত্রা পাক, ভাবমূর্তি রক্ষার ব্যাপারটিও কিন্তু ফেলনা নয়। শাসক তৃণমূলকে সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতেই হবে।