অনুব্রত মণ্ডলরা যেমন আছেন, অনিতা দেবনাথও আছেন। তাহাই ভরসা। আলিপুরদুয়ারের এক পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অনিতা ভোট হইতে সরিয়া দাঁড়াইলেন। ভোট চলাকালীন। তাঁহার দলের কর্মীরাই বুথ দখল করিয়া ছাপ্পা দিতেছিল বলিয়া অভিযোগ। অনিতা জানাইয়াছেন, তাঁহারই জয় নিশ্চিত করিতে এই ছাপ্পা, অশান্তি তিনি মানিতে পারেন নাই। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে ঘটনাটি অতি বিরল। গোটা রাজ্যে যে ৪৮,০০০ আসনে ‘ভোট’ হইয়াছে, এই একটি বাদে অন্য কোনও আসনের প্রার্থী দৃশ্যত এমন বিবেকদংশনে ভোগেন নাই। অনুমান করা চলে, তাঁহারা বিশ্বাস করিয়াছেন, ইহাই রাজনীতির পথ, ইহার নামই গণতন্ত্র। অনিতা দেবনাথ ব্যতিক্রমী। স্বাগত ব্যতিক্রম। ভোটে জিতিয়া পাঁচ বৎসর ক্ষমতায় থাকা, এবং দুর্জনের মতে দুই হাতে উপার্জনের সুযোগ পাওয়াই যে শেষ কথা হইতে পারে না, এই পশ্চিমবঙ্গেও তিনি সেই কথাটি ভুলেন নাই। গণতন্ত্র মানে যে যেন তেন প্রকারেণ ভোটে জিতিয়া আসা নহে, বরং মানুষের মতামতকে শিরোধার্য করিয়া লওয়া, আপাতসরল এই কথাটি মনে রাখা আজিকার পশ্চিমবঙ্গে বিরল চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রমাণ। অনুমান করা চলে, অনিতার লজ্জা করিয়াছিল। যে ভোট মানুষের নহে, যে রায়ে জনমতের ছাপ নাই, তাহারই জোরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াকে তিনি গৌরব বিবেচনা করিতে পারেন নাই। এ লজ্জা মনুষ্যত্বের পরিচয়। অনিতা ভরসা দিলেন, রাজ্যের রাজনীতি হইতে মনুষ্যত্ব বস্তুটি এখনও সম্পূর্ণ উবিয়া যায় নাই।
তাঁহার রাজনৈতিক পরিচয়টিও জরুরি। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের— অর্থাৎ, যে দলটির বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়িয়া গণতন্ত্রকে বেআব্রু করিবার অভিযোগ— সেই দলটির প্রার্থী ছিলেন। তিনি বিরল ব্যতিক্রমী, দলের অন্য আর এক জন প্রার্থীও তাঁহার মতো সাহস দেখাইতে পারেন নাই, সবই সত্য। কিন্তু, তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটিও যে একশৈলিক নহে, অথবা রাজনীতি মানেই যে নৈতিকতাবিবর্জিত একটি পরিসর নহে, অনিতা দেবনাথের উদাহরণ এই কথাটিও প্রমাণ করে। তাঁহারা সংখ্যায় কম, কিন্তু তাঁহারাও আছেন— যাঁহাদের নিকট ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির তুলনায়, দলীয় সঙ্কীর্ণতার তুলনায় গণতন্ত্রের সম্মান অধিকতর জরুরি। এই কথাটি জানা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অতি তাৎপর্যপূর্ণ। এখনও যে রাজনীতির পরিসরটির উপর ভরসা করা চলে, শুধু এই কথাটুকু বুঝাইবার জন্যই নহে। বস্তুত, অনিতা দেবনাথরা পশ্চিমবঙ্গকে একটি বৃহত্তর দায়িত্বের সম্মুখে দাঁড় করাইয়া দেন। তাঁহাদের ন্যায় বিরল, ব্যতিক্রমী চরিত্রকে রক্ষা করিবার দায়িত্ব। কদর্যতার রাজনীতি এই ব্যতিক্রমী চরিত্রগুলিকে কোণঠাসা করিতে, রাজনীতির পরিসর হইতে দূর করিতেই চাহিবে। সেই চেষ্টাকে প্রতিহত করিবার দায়িত্ব বৃহত্তর জনসমাজের। সেই দায়িত্বটি পালন করিতে হইবে সমাজের নিজের স্বার্থেই। যদিও পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিই এখন বৃহত্তম শিল্প, তবুও রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ এখনও রাজনীতি হইতে কোনও প্রত্যক্ষ লাভের প্রাপক নহেন। দলীয় স্বার্থরক্ষার তাগিদ তাঁহাদের নাই। কিন্তু, গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষার দায়িত্ব আছে। কারণ, গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হইলে সেই আঁচ সকলের গায়েই লাগে। অনিতারাই গণতন্ত্রের আব্রু। সমাজকে তাঁহাদের রক্ষা করিবার দায়িত্ব লইতেই হইবে।