অকস্মাৎ বজ্রপাত, তৎক্ষণাৎ জীবনে যবনিকা। বর্ষার কলকাতায় দুই তরুণের মৃত্যুতে শহর তথা রাজ্যের মানুষ মর্মাহত। বিবেকানন্দ পার্কে দেবব্রত পালের মৃত্যুর রেশ না কাটিতে ময়দানে মৃত্যু হইল অজয় মল্লিকের। অজয়ের বাগদত্তা তরুণীও গুরুতর আহত। ইহা কি কেবল দুর্ভাগ্য? বাজ পড়িবার ঘটনা যে বাড়িতেছে, তাহা কি পরিবেশে পরিবর্তন, অথবা দূষণে আধিক্য, অথবা অপর কোনও কারণে? বজ্রপাতে মৃত্যু এড়াইবার যথেষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা কি গ্রহণ করা হইয়াছে শহরে? কী কী সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন, সে সম্পর্কে কি যথেষ্ট প্রচার হইয়াছে? প্রশ্নগুলি গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা, ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প, অতিরিক্ত গরম বা শীত প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণের তুলনায় অধিক মৃত্যু ঘটিয়া থাকে বজ্রপাতে। ২০১৬ সালের বর্ষায় মাত্র একটি দিনে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ডে প্রায় আশি জন প্রাণ হারাইয়াছিলেন। অপরাধ ও অপমৃত্যু সম্পর্কিত সরকারি পরিসংখ্যান (ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো রিপোর্ট) বলিতেছে, ২০০৩ সাল হইতে প্রতি বৎসর অন্তত দেড় হাজার ব্যক্তির মৃত্যু হইয়াছে বজ্রপাতে। ২০১৪ সালে মৃত্যুর সংখ্যা আড়াই হাজারেরও অধিক। বজ্রপাতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা সম্ভবত আরও অধিক। বহু রাজ্যে এখনও বজ্রপাতে মৃতের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নাই। তাই বজ্রাঘাত সম্পর্কে পরিবার সরকারকে জানাইবার প্রয়োজন অনুভব করে না।
হয়তো বন্যা বা ঝড়ের মতো দুর্যোগ নিবারণে ও মোকাবিলায় সরকার যথেষ্ট উদ্যোগ করিয়াছে বলিয়াই সে সকল কারণে মৃত্যু কমিয়াছে। তদুপরি, এই বিপর্যয়গুলিতে এক সঙ্গে বহু মানুষ বিপন্ন হন বলিয়া প্রতিকারের জন্য রাজনৈতিক চাপও অধিক অনুভূত হয়। তুলনায় বজ্র এক জন, অথবা মাত্র কয়েক জন ব্যক্তিকেই আঘাত করে। তাই সে যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না। বজ্রপাতে মৃত্যু এড়ানো সম্ভব, এই ধারণাই হয়তো অনেকের নাই। কিন্তু সংবাদে প্রকাশ, বজ্রপাতের সম্ভাবনা আগাম অনুমান করা যাইতেছে। বিজ্ঞানীরা তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বাতাসে জলকণার উপস্থিতি-সহ নানা উপাদান লইয়া এক সূচক নির্মাণ করিয়াছেন। তাহার তারতম্য হইতে বজ্রপাতের সম্ভাবনার পূর্বাভাস সম্ভব বলিয়াই তাঁহাদের দাবি। আবহাওয়া বিজ্ঞান হইতে এমন সহায়তা মিলিলে সরকার কেন তাহা ব্যবহার করিবে না? কেন তাহা কাজে লাগাইয়া শহরের কিছু অংশকে ‘বিপদসঙ্কুল এলাকা’ বলিয়া আগাম সতর্ক করিবে না নাগরিককে? কেন কিছু এলাকায় ওই উপাদানগুলির হেরফের ঘটিতেছে, কোনও উপায়ে সঙ্কট এড়াইতে পারা যায় কি না, সেই গবেষণাতেও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
তবে বজ্রপাত একটি ইঙ্গিতমাত্র। নগরবাসী প্রকৃতিকে জীবননাট্যের মঞ্চে প্রেক্ষাপট বলিয়া ভাবিতেই অভ্যস্ত। প্রকৃতি কিন্তু জীবননাট্যে এক বিশিষ্ট চরিত্র। বাকি নটনটীর কার্যকলাপ দ্বারা তাহার ভালমন্দ ঘটিয়া থাকে, এবং সে-ও অপর চরিত্রের উপর প্রভাব ফেলিয়া থাকে, সেই কথাটি আমরা ভুলিয়াছি। মাঝে মাঝে প্রকৃতিকে প্রাণঘাতী খলনায়কের ভূমিকায় রাখিলেই চলিবে না। এই বার বুঝিতে হইবে, আধুনিক নগরেও প্রকৃতি সজীব, সক্রিয়, সতত পরিবর্তনশীল এক শক্তি। তাহার উপর আঘাত করিলে জাগতিক নিয়মেই প্রত্যাঘাত আসিবে। কেবল ভাগ্যের দোষ দিয়া লাভ নাই।