সম্পাদকীয় ২

নারীবাদের জুজু

না রীবাদ লইয়া অনেকেরই বিস্তর সংশয়। যদি কাহাকেও জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কি নারীবাদী— তাহা হইলে অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট উত্তর মিলিবে না, আরও অনেক ক্ষেত্রে স্পষ্ট উত্তর মিলিবে: না, আমি নারীবাদী নই। ব্যাখ্যা চাহিলে অনেকেই হয়তো বলিবেন, নারীর প্রতি শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যমূলক আচরণ তাঁহারা সমর্থন করেন না, কিন্তু নিজেকে নারীবাদী বলিয়া ঘোষণা করিতে তাঁহাদের বড় আপত্তি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

না রীবাদ লইয়া অনেকেরই বিস্তর সংশয়। যদি কাহাকেও জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কি নারীবাদী— তাহা হইলে অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট উত্তর মিলিবে না, আরও অনেক ক্ষেত্রে স্পষ্ট উত্তর মিলিবে: না, আমি নারীবাদী নই। ব্যাখ্যা চাহিলে অনেকেই হয়তো বলিবেন, নারীর প্রতি শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যমূলক আচরণ তাঁহারা সমর্থন করেন না, কিন্তু নিজেকে নারীবাদী বলিয়া ঘোষণা করিতে তাঁহাদের বড় আপত্তি। সম্প্রতি মালালা ইউসুফজাই স্বীকার করিলেন, নারীবাদকে ঘিরিয়া এই বিভ্রান্তি এবং সংশয় তাঁহার মনেও ছিল। নিজেকে নারীবাদী বলিতে যথেষ্ট কুণ্ঠা ছিল। কিন্তু অবশেষে সঙ্কোচের সেই বিহ্বলতা তিনি কাটাইয়া উঠিয়াছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জে অভিনেত্রী এমা ওয়াটসনের বক্তৃতা তাঁহার মনের অন্ধকার দূর করিয়াছে। এখন তিনি নিজেকে নারীবাদী হিসাবে পরিচয় দিতে প্রস্তুত।

Advertisement

মালালা যে সংশয়ের শিকার ছিলেন, তাহা বিশ্ব জুড়িয়া নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষের মধ্যে বহমান। সাধারণ মানুষ তো ছার! শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ-কলাকুশলীরাও এই প্রবণতা থেকে মুক্ত নহেন। বিশেষত যাঁহারা জনপ্রিয় মুখ, সাধারণ্যে নিজ ভাবমূর্তি লইয়া যাঁহাদের চিন্তিত থাকিতে হয়, নারীবাদের জুজু তাঁহারা বেশি দেখিয়া থাকেন। নারীর অধিকার প্রসঙ্গে কোনও মতামত দিবার আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো তাঁহারা বলিয়া রাখেন, আমি কিন্তু নারীবাদী নহি। যেন নারীবাদী তকমা গায়ে লাগিলেই জাত যাইবে! আশঙ্কাটি একেবারে অমূলকও বলা যায় না। কারণ নারীবাদকে সাধারণ ভাবে আপদবিশেষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবার চল সমাজে নাই। ‘নারীবাদ’ মানে কিছু বদ্ধমূল— উগ্রচণ্ডা পুরুষবিদ্বেষী, কলহপরায়ণ, অসামাজিক, উচ্ছৃঙ্খল এবং অতৃপ্ত সংকীর্ণচিত্ত মহিলার দল। উটকো অশান্তি বাধানোই যাঁহাদের একমাত্র কাজ। পিতৃতন্ত্রের প্রচারযন্ত্রই নারীবাদের এই প্রতিবিম্বটি সযত্নে রচনা করিয়াছে। করিতে বাধ্য হইয়াছে। নচেৎ স্বীয় অস্তিত্বের শিকড়ে টান পড়িবে। এবং নারীবাদকে কোণঠাসা করিতে তাহার কূট প্রচার যে এত ব্যাপক ভাবে সমাজমনকে আচ্ছন্ন করিতে পারিয়াছে, তাহাতেই প্রমাণ, পিতৃতন্ত্রের কালো হাত অদ্যাবধি কতখানি মজবুত।

নারীবাদের সপক্ষে প্রচারের প্রয়োজন অতএব সমধিক বাড়িতেছে। মালালার মতো মেয়েরা আগাইয়া আসিলে সেই কাজটি গতি পাইবে। এমার কথা শুনিয়া যেমন মালালার ভুল ধারণা ভাঙিয়াছে, মালালার কথা শুনিলে আরও অনেকে উজ্জীবিত হইবে। মালালা-এমারা জোর গলায় বলিয়াছেন, সমতার আর এক নাম নারীবাদ। অর্থাৎ নারীবাদকে সমর্থন করা মানে সমতার দাবিকে সমর্থন করা। নারীবাদকে সমর্থন না করা মানে তেমনই সমতার আদর্শ হইতে পিছু হটা। এ কথা ঠিক যে, নারীবাদের মধ্যেও নানা মত ও পথের সমাহার আছে। নারীবাদ কোনও একরৈখিক ধারণা নহে। কিন্তু এই বিভিন্নতা যে কোনও মতবাদের মধ্যেই থাকে এবং তাহা স্বাস্থ্যের লক্ষণ। বহু স্বরের উপস্থিতি দুর্বলতা কেন হইবে! দুর্বল সেই ব্যক্তি, যে নারীবাদের নাম শুনিলে আঁতকাইয়া ওঠে! কারণ সে সম্যক জানে, নারীবাদ শুধু খানকয়েক স্লোগান নহে। নারীবাদ মানে জীবনচর্যার প্রতিটি ধাপে, ভাষার প্রতিটি উচ্চারণে, আচরণের প্রতিটি ছত্রে লিঙ্গসমতাকে মান্য করা। ভাবনার যাবতীয় জগদ্দলে ঘা দেওয়া। সেখানে পদে পদে উলঙ্গ হইয়া পড়ার ভয়। নারীবাদকে বাস্তবিকই অস্পৃশ্য করা সহজ, আলিঙ্গন করা কঠিন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement