প্রতীকী ছবি।
রোদে-নীলে মাখামাখি একটা আকাশ থেকে যেন আচমকা বজ্রপাত। আর সে বজ্রপাতে হাজার হাজার সরকারি কর্মীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়। এক অকল্পনীয় বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কর্মী। চোখের সামনে থেকে হঠাৎ যেন ধসে গিয়েছে ধরিত্রী।
সেপ্টেম্বর মাস থেকে আর বেতন দেওয়া হবে না অনুমোদনহীন সরকারি পদে কর্মরতদের। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়ে গিয়েছিল অগস্টের শেষ দিকেই। হইচই তখন একেবারেই হয়নি। কারণ তখন বোঝাই যায়নি যে, এত বৃহদাকার ছায়া ফেলবে রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপ। অনুমোদনহীন পদ গুনতে গিয়ে কেঁচোর বদলে কেউটে বেরিয়ে আসার জোগাড়। দেখা যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কর্মীর পদ অনুমোদনহীন! অর্থাৎ তাঁরা দিনের পর দিন অফিসে যাচ্ছেন, কাজ করছেন, বেতন পাচ্ছেন, কিন্তু সরকারের পাকাপোক্ত খাতায় তাঁদের নামই নেই, সরকারি কর্মী হিসেবে তাঁদের কোনও বৈধতাই নেই।
এই রকম পরিস্থিতির কথা কে কতবার শুনেছেন? স্মরণাতীত কালে কি রাজ্যে এই রকম বিস্ময়কর পরিস্থিতির কথা শোনা গিয়েছে?
সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অন্যায্য— এমন কথা বলা যাচ্ছে না। সরকারের অনুমোদন ছাড়াই যাঁরা বিভিন্ন সরকারি দফতরে ঢুকে পড়েছেন, তাঁদের দায় সরকার নিতে চাইছে না। সরকার যে পদ অনুমোদনই করেনি, সেই পদে কর্মরত কাউকে সরকার বেতন দেবেই বা কেন? রাজকোষে জমা পড়া অর্থের অপচয় বা অপব্যবহার হতে না দেওয়া তো সরকারের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে রাজ্যের অর্থ দফতর উপযুক্ত পদক্ষেপই করেছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
কিন্তু প্রশ্ন তো উল্টো দিকেও রয়েছে অনেকগুলো। সরকারি দফতরগুলোয় সরকারের অনুমোদন ছাড়াই প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কর্মী ঢুকে পড়লেন কী করে? কারা এঁদের নিয়োগ করলেন? নিয়োগের সময়ে কী পদ্ধতি অনুসৃত হল? যে সব পদের অনুমোদনই দেওয়া হয়নি, সেই সব পদের জন্য সরকার এত দিন ধরে বেতনই বা কেন দিল? নিজেদেরকে সরকারি কর্মী জেনে যাঁরা এত দিন সরকারি দফতরে কাজ করলেন, আজ আচমকা তাঁদের বেতন বন্ধ হয়ে যেতে পারে কী ভাবে? চাকরিই বা যেতে পারে কী ভাবে?
৫০টি সরকারি বিভাগে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাড়ে ১৭ হাজার কর্মীর নিয়োগ কি অবৈধ উপায়ে হয়েছিল? তেমন কোনও কথা প্রশাসন হলফ করে বলতে পারছে না এখনই অন্তত। তা হলে কী ভাবে বেতন বন্ধ হবে? বৈধ পথে যদি নিয়োগ হয়ে থাকে, তা হলে সরকার কী ভাবে দায় অস্বীকার করবে? রাজ্যের অর্থ দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, নিয়োগ বৈধ পথে হলেও কর্মী অবৈধ হতে পারেন। সরকার নির্দিষ্ট ভাবে যে সব পদের অনুমোদন দিয়েছে, সেই সব পদের বাইরে নিয়োগ হয়ে থাকলে, সে সব নিয়োগ যথার্থ নয়।
আরও পড়ুন: সরকারি অফিসে যান, মাইনেও পান, বেকার হতে চলেছেন এমন ১৭,৫০০ অবৈধ কর্মী!
সরকারের যুক্তি অকাট্য— যে পদ সরকার অনুমোদনই করেনি, সেই পদের জন্য সরকার খরচ করবে না। কিন্তু যাঁরা বৈধ পথে সরকারি চাকরি পেলেন, বেতন পেতে শুরু করলেন, নতুন জীবন শুরু করলেন, তাঁদের অপরাধটা কোথায়? তাঁরা কী ভাবে জানবেন যে, বৈধ উপায়ে আবেদন করে, বৈধ ভাবে পরীক্ষায় পাশ করে, বৈধতার সঙ্গে ইন্টারভিউতে উতরে গিয়ে যে পদে তাঁরা কাজ শুরু করলেন, সেই পদটা আসলে অনুমোদিতই নয়? এত দিন চাকরি করার পরে আচমকা যদি বলা হয়, আর বেতন মিলবে না বা আর চাকরি নেই, তা হলে এই সাড়ে ১৭ হাজার লোক যাবেন কোথায়? কী হাল হবে তাঁদের পরিবার-পরিজনের? ওই চাকরিটায় বলীয়ান হয়ে যে সব দায়বদ্ধতার ভাগিদার হয়ে গিয়েছিলেন এই সাড়ে ১৭ হাজার, সেই সব দায়বদ্ধতা থেকে আচমকা তাঁরা মুক্তি পাবেন কী করে?
গলদ যে একটা গুরুতর হয়েছে, সে তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সে গলদ হয়তো সরকারি নীতির গলদ নয়। কিন্তু সে গলদ তো এই সাড়ে ১৭ হাজার কর্মীরও নয়। তা হলে সে গলদের খেসারত এঁরা কেন দেবেন? এই মারাত্মক ত্রুটি প্রত্যক্ষ ভাবে যাঁদের হাত দিয়ে ঘটল, খেসারত তাঁরাই দিন।
অন্ত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপটা করতে হবে সরকারকে| অনুমোদন না দেওয়া সত্ত্বেও এই বিপুল সংখ্যক কর্মীকে বেতন দেওয়ার খরচ এত দিন ধরে বইতে হচ্ছিল সরকারকে, এটা মেনে নেওয়া যায় না| আবার নিজেদের কোনও অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও এই বিপুল সংখ্যক কর্মীর বেতন বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটাও হতে পারে না| তাই এই কর্মীদের জন্য বিকল্প পথ খুঁজুক সরকার| আর খুঁজে বার করুক সেই সব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা বা আধিকারিকদের, যাঁদের হাত দিয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত এই অনিয়ম ঘটেছে, যাঁদের জন্য এত সরকারি কর্মীর ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে|
নিয়োগের প্রক্রিয়াতেও নিশ্চয়ই ফাঁক রয়েছে কোনও| না হলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই অনিয়ম চলতে পারত না| সেই ফাঁকটা বা ফাঁকগুলোও আজ চিহ্নিত হওয়া দরকার| না হলে ভবিষ্যতেও এই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে আবার|