বহুদলীয় রাজনীতির সঙ্গে শীঘ্রই খাপ খাইয়ে নিতেই হবে দুই বৃহত্তম জাতীয় দলকে।
একচ্ছত্র আধিপত্যের ভূমি এ নয়। একা একা কিছু হয় না এ ভারতে। সবাই মিলে হয়, সবার অংশগ্রহণে হয়, ঐক্যবদ্ধ বৈচিত্রে হয়। কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচন সেই শিক্ষা দিয়ে গেল কিয়দংশে।
ভারত যে বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন সামাজিক রীতি ও প্রথা, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমাহার— তা কোনও ভারতবাসীরই অজানা নয়। ভারতীয় জীবনধারা বলতে কোনও একটি মৌলিক জীবনধারাকে বোঝায় না। নানা জীবনচর্যা পাশাপাশি অবস্থান করে এ দেশে। মৌলিক অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে পরস্পরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কলাই হল ভারতীয়ত্ব। ভারতীয় জনগোষ্ঠী সে কলা রপ্ত করেছে দীর্ঘ সহাবস্থানের সূত্রেই। সেই সহাবস্থান এবং সবার আশা-আকাঙ্খার আত্তীকরণকে অস্বীকার করে এ দেশে রাজত্ব করা সম্ভব নয়। সাময়িক ভাবে বা আংশিক ভাবে হয়ত সম্ভব। কিন্তু চিরন্তন বা সামগ্রিক ভাবে অসম্ভব।
ভারতীয় জীবনধারা বা বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের এই সারকথা কিন্তু ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাজনীতির সঙ্গে সমাজ বা জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক গোটা পৃথিবীতেই অঙ্গাঙ্গী। ভারতের মতো দেশে সে সম্পর্ক আরও নিবিড়। জাতিগোষ্ঠী, ধর্মগোষ্ঠী, ভাষাগোষ্ঠী বা ভিন্নতর সূত্রে বাঁধা কোনও জনগোষ্ঠী— প্রত্যেকের নিজস্ব আশা-আকাঙ্খা রয়েছে এ দেশে, চাওয়া-পাওয়া রয়েছে। রয়েছে অস্মিতা, রয়েছে ভাবাবেগ, রয়েছে বিশ্বাস। ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর এই চাওয়া-পাওয়া, এই আকাঙ্খা, এই অস্মিতা-ভাবাবেগ-বিশ্বাসও পরস্পরের থেকে কোথাও কোথাও ভিন্ন ভিন্ন। আর সেখানেই বিভাজনের রেখা, সেখানেই সঙ্ঘাতের অবকাশ।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ভারতীয় সমাজের এই চেহারাকে কেউ বিভাজন বলতে পারেন, কেউ বলতে পারেন বৈচিত্র। পরিভাষা যা-ই হোক, সমাজের এই চেহারাই কিন্তু জন্ম দিয়েছে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার। কারণ ভারতের যে কোনও প্রান্তেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সামাজিক টানাপড়েনও অবাধারিত ভাবে রাজনীতির অঙ্গ হয়ে ওঠে। সামাজিক আশা-আকাঙ্খার ভার রাজনীতিকে অনেকটাই বইতে হয় এ দেশে। এবং জটিল ও যৌগিক চেহারার সামাজিক কাঠামোয় কোনও একটি বা দু’টি রাজনৈতিক দলের পক্ষে সুবিশাল জনগোষ্ঠীর সব অংশের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না।
আরও পড়ুন: একক বৃহত্তম বিজেপি, কিন্তু কংগ্রেসের চালে নাটক টানটান, সরকার গড়ার দাবি দু’পক্ষেরই
এই সত্যকে কিছুটা অস্বীকার করেই হয়ত আজ গোটা ভারতে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের স্বপ্নে বিভোর বিজেপি। কারণ রাজ্য বা আঞ্চলিক স্তরের ২৯টি সরকারের মধ্যে ২০টি-ই এখন বিজেপি বা তার জোটসঙ্গীদের হাতে। কংগ্রেসও একই স্বপ্ন দেখে। কারণ বর্তমানে হীনবল হলেও একটা সুদীর্ঘ সময় ধরে দেশের এক বিরাট অংশে কংগ্রেসের আধিপত্যও একচ্ছত্রই ছিল। কিন্তু কংগ্রেস-বিজেপি কেউই এই সত্য সম্ভবত উপলব্ধি করতে পারছে না যে, সে কালের দেশজোড়া কংগ্রেসি আধিপত্য বা এ কালের দেশজোড়া গেরুয়া হাওয়া আসলে সাময়িক প্রবণতা। এ চিরন্তন নয়। নির্দিষ্ট বা বিশেষ কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন অবকাশ তৈরি হতেই পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে কারও একাধিপত্যই স্থায়ী হওয়ার নয় এ দেশে। ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের এবং ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নানা আকারের রাজনৈতিক শক্তি মাথা তুলবেই ভারতে। তাদের সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে বৃহৎ শক্তিগুলিকে। না হলে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডি পর্যন্ত দৌড়নোর পর হাঁফিয়ে পড়তেই হবে।
আরও পড়ুন: সিদ্দায় আস্থা রাখায় জলে রাহুলের চেষ্টা
কর্নাটকের ৪০ থেকে ১০৪ আসনে উঠে এসেছে বিজেপি, একক বৃহত্তম দল হয়ে উঠেছে। নিঃসন্দেহে বিজেপি অভিনন্দনযোগ্য ফল করেছে। কিন্তু এ-ও মাথায় রাখতে হবে যে, বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতায় পৌঁছতে পারেনি। কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়ার ডাক দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে যে বিজেপি, ভারতের সব রাজ্যে গেরুয়া ঝান্ডা উড্ডীন করার অঙ্গীকার শোনাচ্ছে যে বিজেপি, সেই বিজেপি কর্নাটকে একক সক্ষমতায় ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছতে পারল না।
অন্য প্রান্তে রয়েছে কংগ্রেস। বৃহত্তর বিজেপি বিরোধী জোট গড়ে নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শ কংগ্রেসকে দিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু কংগ্রেস একক সক্ষমতায় সরকার ধরে রাখতে চেয়েছিল। ভোটের ফল স্পষ্ট দেখাচ্ছে, রাজ্যবাসী প্রত্যাখ্যান করেছে কংগ্রেসকে। এখন বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে জেডি(এস)-এর দিকে হাত বাড়াতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মুখ্যমন্ত্রিত্বটাই জেডি(এস)-কে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে হচ্ছে।
কর্নাটক আসলে গোটা ভারতের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে ধরা দিল। এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিতে হবে দুই বৃহত্তম জাতীয় দলকেই।
বিজেপিকে বুঝতে হবে, উগ্র জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় মেরুকরণে সওয়ার হয়ে অনেকটা হয়ত এগনো যায়, কিন্তু পুরোটা হয় না। অনেক মানুষই ওই উগ্র বন্ধনীতে ধরা দিতে চান না, বাইরেই থেকে যান। কারণ তাঁরা অন্য ভাবে ভাবেন এবং এই অন্য রকম ভাবনার নাগরিকরা যে কোনও অর্থেই সংখ্যালঘু নন, তাও স্পষ্ট হয়ে যায় কর্নাটকে বিজেপির ভোটপ্রাপ্তির হিসেবটা দেখলেই।
আরও পড়ুন: হিসেবি মেরুকরণ খেটে গেল মোক্ষম
কংগ্রেসকে বুঝতে হবে, অতীত গৌরবের বর্মটা সরিয়ে রাখার সময় হয়েছে। একা একা পথ চলা আর সম্ভব নয়। অন্য অনেককে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে এ বার। না হলে ক্রমশ শক্তিক্ষয় হবে, রক্তক্ষরণ বাড়বে, হীনবল হয়ে পড়তে হবে আরও । ভোটের আগে জেডি(এস)-এর হাত ধরার অবকাশ ছিল। সে ক্ষেত্রে বড় শরিক হিসেবেই হাতটা ধরা যেত। ভোটের পরে যখন জেডি(এস)-এর হাতটা ধরতে হচ্ছে, তখন নিজেদের আসন বেশি থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রিত্ব জেডি(এস)-কে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে হচ্ছে।
দ্বিদলীয় রাজনীতির যুগ এখন অতীত ভারতে। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সব অংশই এখন নিজের নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। জনগোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক দল বা রাজ্য দলের অস্তিত্ব এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়। লোকসভায় ৪৪টি আসন পাওয়া দল এ সত্যকে যেমন অস্বীকার করতে পারে না, তেমনই পারে না ২৮২ আসনের দলও। অস্বীকার করতে গিয়েই বিপদ ঘনিয়েছে কর্নাটকে। একচ্ছত্র কট্টরবাদের আশঙ্কাই হয়ত কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে কর্নাটকে বিজেপির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের পথে। আর কংগ্রেসের ভরাডুবি নিশ্চিত করেছে ক্ষমতার একচ্ছত্র হকদার হওয়ার অবান্তর বাসনা।
দ্বিদলীয় রাজনীতি এখনও সচল ভারতের কিছু কিছু রাজ্যে। রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়— এখনও হয় বিজেপি, না হয় কংগ্রেসের উপরে ভরসা রাখছে এই রাজ্যগুলি। কিন্তু ভারতের আর কোনও অংশেই রাজনীতিটা এখন আর এই রকম দ্বিমাত্রিক নয়। এই বহুদলীয় রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেই হবে দুই বৃহত্তম জাতীয় দলকে। ক্ষুদ্রতর শক্তিগুলিকে এবং তাদের দাবিদাওয়া ও কর্মসূচিগুলিকে স্বীকৃতি দিয়ে যদি তাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে দুই বৃহত্ দল, তা হলেই ভারতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব ধরে রাখা সহজ হবে দুই বৃহত্ দলের পক্ষে। তা না করতে পারলে ভবিষ্যত্ আরও কঠিন হতে পারে।